সাধারণ অর্থে, অধিকার বলতে কোন স্বত্ব বা দাবিকেই বুঝায় কিন্তু এ দাবি স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে অধিকারের সৃষ্টি হয় না। সমাজের মধ্যেই এর স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। তাই অধিকার হলো। একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণা। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকারের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে অধিকারের উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞাগুলো উল্লেখ করা হলো :
গিলক্রিস্ট (Gilchrist) বলেছেন, “Rights arise from the fact that man is social and political being.”
বোসাংকেত (Bosanquet) এর মতে, “অধিকার হলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি।” (A right is a claim recognised by society and enforced by the state.)
অধ্যাপক লাঙ্কি (Prof. Laski) এর মতে, “বস্তুত অধিকার হলো সমাজজীবনের সেসব অবস্থা যেগুলো ছাড়া কোন মানুষ সাধারণভাবে তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বা পরিপূর্ণ বিকাশে সচেষ্ট হতে পারে না।”
টি. এইচ. গ্রিন (T. H. Green) বলেছেন, “সমষ্টিগত নৈতিক কল্যাণ সম্পর্কে চেতনা ছাড়া অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব।”
বার্কার (Barker) এর মতে, “অধিকার হলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সেসব সুযোগ সুবিধা যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Wildo বলেছেন, “অধিকার হচ্ছে স্বাধীনতার একটি যৌক্তিক দাবি যা নির্দিষ্ট কর্মের অনুশীলন মাত্র।”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, অধিকার হলো প্রত্যেক ব্যক্তির বা সমষ্টির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত সুযোগ সুবিধা। অর্থাৎ কোন সুযোগ সুবিধা দু’টি শর্ত পূরণ করলে
তা অধিকার হিসেবে গণ্য হয়। যথা :
১. সুযোগ সুবিধা প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হবে এবং ২. রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে।
অধিকারের প্রকৃতি আলোচনা।
অধিকার নাগরিক জীবনের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে অধিকার বলতে কোন স্বত্ব বা দাবিকেই বুঝায়। কিন্তু এ দাবি স্বীকৃত ও সংরক্ষিত না হলে অধিকারের সৃষ্টি হয় না। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেই এর স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। সুতরাং অধিকার হলো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়।
নিম্নে অধিকারের বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক ধারণা : সামাজিক ধারণা থেকেই অধিকারের উৎপত্তি। অধিকার সমাজের মধ্যে লালিত, সমাজের বাইরে এর কল্পনা করা যায় না। সুতরাং অধিকার হলো একটি সামাজিক ধারণা।
২. রাজনৈতিক ধারণা : অধিকার একটি রাজনৈতিক ধারণাও বটে। কেননা, রাষ্ট্রই মানুষের অধিকার আদায় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। রাষ্ট্র প্রণীত আইনের মাধ্যমে মানুষ তার অধিকার ভোগ করে।
৩. সুযোগ সুবিধার সমষ্টি : অধিকার হচ্ছে কতিপয় সুযোগ সুবিধার সমষ্টি বা যোগফল। এসব সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত। এজন্য অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেছেন, “অধিকার হলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সেসব সুযোগ সুবিধা যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।”
৪. কল্যাণমূলক : অধিকার একটি কল্যাণমূলক ধারণা। নাগরিকগণ যেসব অধিকার ভোগ করে থাকে তা সকলের কল্যাণেই নিবেদিত। রাষ্ট্র নাগরিকরে অধিকার প্রদান করে ব্যক্তির কল্যাণ নিশ্চিত করে থাকে।
৬. পরিবর্তনশীলতা : অধিকার একটি পরিবর্তনশীল বিষয়। সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের অধিকার পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
৭. আইনানুগ : অধিকার একটি আইনানুগ বিষয়। এর পিছনে আইনের সমর্থন রয়েছে, বিধায় এগুলো সহজে কেউ খর্ব বা ভঙ্গ করতে পারে না।
পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ অধিকারের মৌলিক দিক। এগুলো ব্যতীত মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না। মানুষ অধিকার ছাড়া সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপন করতে পারে না।
অধিকার কত প্রকার ও কী কী? আলোচনা কর।
সাধারণত অধিকার বলতে কোন দাবি বা স্বত্বকে বুঝায়। যা রাষ্ট্র বা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই অধিকার ভোগ করা যায়। রাষ্ট্রের আইন দ্বারা অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। অধিকার আবার বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
প্রকৃতি অনুসারে অধিকার তিন প্রকার। যথা :
১. প্রাকৃতিক অধিকার
২.নৈতিক অধিকার এবং
৩. আইনগত অধিকার।
নিম্নে অধিকারের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্রাকৃতিক অধিকার : মানুষ যেসব অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাই প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Rights), মূলত প্রাকৃতিক অধিকার বলতে সেসব অধিকারকে বুঝায় যা মূলত এমনকি রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে ভোগ করতো। জনলক এর মতে, প্রাকৃতিক অধিকার কখনো বিনষ্ট হয় না। এরূপ অধিকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিরও ঊর্ধ্বে। জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার অধিকার হচ্ছে মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার।
২. নৈতিক অধিকার : মানুষের বিবেক ও বিবেচনার উপর ভিত্তি করে যেসব অধিকারের সৃষ্টি হয় তাই নৈতিক অধিকার। নৈতিক অধিকার নীতি, আদর্শ ও বিবেক বিবেচনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন-প্রবীণদের শ্রদ্ধা, সেবা শুশ্রূষা, গরিব ও অসহায়দের সাহায্য সহযোগিতা ইত্যাদি নৈতিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত।
৩. আইনগত অধিকার : রাষ্ট্রের আইন দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত অধিকারসমূহকে আইনগত অধিকার বলে। আইনগত অধিকারের পিছনে আইনের সমর্থন থাকায় কেউ এসব অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে কিংবা বাধা দিলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করে। আইনগত অধিকারকে আবার কতকগুলো ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
যথা : (ক) সামাজিক অধিকার, (খ) রাজনৈতিক অধিকার, (গ) অর্থনৈতিক অধিকার, (ঘ) সাংস্কৃতিক অধিকার এবং (ঙ) মৌলিক অধিকার। নিম্নে এসব অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. সামাজিক অধিকার : মানুষ সুসভ্য ও সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করে তাকে সামাজিক অধিকার বলে। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজকল্যাণকর সুযোগ সুবিধাকেই সামাজিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন-শিক্ষার অধিকার, ধর্মের অধিকার, স্বাস্থ্যরক্ষার অধিকার স্বাধীন গতিবিধির অধিকার, সামাজিক সাম্যের অধিকার ইত্যাদি।
খ. রাজনৈতিক অধিকার : রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণের অধিকারকে রাজনৈতিক অধিকার বলে। নাগরিক হিসেবে ব্যক্তি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব অধিকার ভোগ করে সেগুলো হলো : ভোটদানের অধিকার, নির্বাচন করার অধিকার, সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের অধিকার, সরকারের সমালোচনা করার অধিকার ইত্যাদি।
গ. অর্থনৈতিক অধিকার : অর্থনৈতিক অধিকার বলতে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব থেকে মুক্তিলাভের অধিকারকে বুঝায়। কর্মের অধিকার, ন্যায্য মজুরি পাওয়ার অধিকার, অবকাশ লাভের অধিকার ইত্যাদি মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত। অর্থনৈতিক অধিকার ব্যতীত ব্যক্তির পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। তাই অর্থনৈতিক অধিকার মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঘ. সাংস্কৃতিক অধিকার : ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণের জন্য তার যেসব সুযোগ সুবিধা সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত তাকে সাংস্কৃতিক অধিকার বলে। যেমন- সংগীত চর্চা, নৃত্যচর্চা, অভিনয় ইত্যাদি।
ঙ. মৌলিক অধিকার : মানুষের মৌলিক অধিকার বলতে সেসব অধিকারকে বুঝানো হয় যেগুলো ছাড়া মানুষ জীবনযাপন করতে পারে না। যেমন-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার।
উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, অধিকার ছাড়া মানুষ সুষ্ঠুভাবে সমাজে বসবাস করতে পারে না। চুক্তিবাদী দার্শনিকগণ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক অধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে আধুনিক দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ মানুষের নৈতিক ও আইনগত অধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মোটকথা, এসব অধিকার ছাড়া মানুষ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে না। তাই অধিকার মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
কর্তব্যের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
কর্তব্য বলতে রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে নাগরিকগণ রাষ্ট্রের প্রতি যেসব দায়িত্ব পালন করে তাকে বুঝায়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাগরিকের অধিকারের মতো কর্তব্যের উপরও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। নাগরিকগণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেমন কিছু অধিকার ভোগ করে, তেমনি রাষ্ট্রও নাগরিকের কাছ থেকে কিছু কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের আশা করে। মূলত নাগরিকের দায়িত্বগুলোই হলো কর্তব্য।
কর্তব্যের শ্রেণিবিভাগ বা প্রকারভেদ : একজন সভ্য নাগরিকের বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। তবে কর্তব্যকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :ক. নৈতিক কর্তব্য এবং খ. আইনগত কর্তব্য। নিম্নে এসব কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. নৈতিক কর্তব্য : নৈতিক কর্তব্য হলো সেসব দায়িত্ব যা উচিত বলে মনে করা হয়। এর পিছনে কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। নৈতিক কর্তব্য ব্যক্তি বা সমাজের নীতিবোধ ও বিবেকবোধের উপর নির্ভর করে। নৈতিক কর্তব্য পালন না করলে সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় তবে রাষ্ট্র কোন শাস্তি দিতে পারে না। নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : মাতা পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভরণপোষণ, গরিব দুঃখীদের সাহায্য করা ইত্যাদি।
খ. আইনগত কর্তব্য : রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কর্তব্য বলতে মূলত আইনগত কর্তব্যকে বুঝায়। আইনগত কর্তব্য বলতে বুঝায় এমন এক ধরনের কর্তব্য যা রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সৃষ্ট ও অনুমোদিত। আইনগত কর্তব্য আইনানুমোদিত বিধায় নাগরিককে অবশ্যই এগুলো পালন করতে হয়। আইনগত কর্তব্যকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা : ১. সামাজিক কর্তব্য, ২. রাজনৈতিক কর্তব্য ও ৩. অর্থনৈতিক কর্তব্য। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক কর্তব্য : মানুষের সমাজজীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও কল্যাণকর করার মানসে প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার প্রতিদানস্বরূপ যেসব দায়িত্ব পালন করা হয় তাকে সামাজিক কর্তব্য বলে। যেমন-খাদ্য উৎপাদন, মানুষের বিয়ে ও মৃত্যুকালে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন ইত্যাদি।
২. রাজনৈতিক কর্তব্য : রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে নাগরিকগণ রাষ্ট্রের প্রতি যেসব রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করে তাই রাজনৈতিক কর্তব্য। যেমন-রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, সংবিধান মেনে চলা, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দানের মাধ্যমে নির্বাচন করা ইত্যাদি।
৩. অর্থনৈতিক কর্তব্য : রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নাগরিকগণ যেসব দায়িত্ব পালন করে তাই অর্থনৈতিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য হয়। যেমন- উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাজে নাগরিকের যেসব দায়িত্ব রয়েছে তাই অর্থনৈতিক কর্তব্য।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকগণ যেসব দায়িত্ব পালন করে তাই কর্তব্য। রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির জন্য নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা অত্যাবশ্যক।
অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা ।
অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। অধিকার হলো প্রত্যেক ব্যক্তির বা
জনসমষ্টির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত সুযোগ সুবিধা। আর কর্তব্য হচ্ছে এমন এক নীতিনিষ্ঠ আচরণ বা দায়িত্ববোধ যা সকল সময়ই মানুষ পালন করতে বাধ্য থাকে। নাগরিকগণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেমন অধিকার ভোগ করে তেমনি নাগরিকদেরও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। বস্তুত কর্তব্য ছাড়া অধিকার পরিপূর্ণ হয় না। নিম্নে অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যেকার সম্পর্ক বা সাদৃশ্য আলোচনা করা হলো :
১. উৎপত্তিগত সম্পর্ক : অধিকার ও কর্তব্য উভয়ের উৎপত্তি সমাজের মধ্যে। সমাজ হলো অধিকার ও কর্তব্যের সংরক্ষক ও অভিভাবক। সমাজ ও রাষ্ট্র প্রদত্ত অধিকারের বিনিময়ে আমরা কর্তব্য পালন করে থাকি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, অধিকার ও কর্তব্যের উৎপত্তি এক ও অভিন্ন।
২. অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য বিদ্যমান : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বহুল প্রচলিত উক্তি হলো “Right imply duties” অর্থাৎ অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত। সমাজবদ্ধ মানুষ একে অপরের উপর কতকগুলো দাবি করে। এ দাবি স্বীকৃত হলে অধিকারের সৃষ্টি হয়। আর এগুলো স্বীকার করার অর্থ হলো কতকগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অঙ্গীকার করা। মূলত পারস্পরিক এ দাবিসমূহের একদিক হলো অধিকার এবং অপরদিক হলো কর্তব্য।
৩. অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল : রাষ্ট্রই নাগরিকদের অধিকারের পথ দেখায় এবং যথাযথ অধিকার সংরক্ষণ করে। অন্যদিকে নাগরিক যদি তার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন না করে তাহলে রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়বে এবং নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ করতে পারবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল।
৪. কর্তব্য পালনের মাধ্যমে অধিকার অর্জন করতে হয় : ব্যক্তি সত্তা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকার অর্জন করতে হয়। কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তা অর্জন করা যায়। সুতরাং অধিকার ও কর্তব্য পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ।
৫. একজনের অধিকার অন্যের কর্তব্য : একজন নাগরিক যে অধিকার ভোগ করে অন্যজন তা সংরক্ষণের জন্য কর্তব্য পালন করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবহাউস বলেছেন, “ধাক্কা না খেয়ে পথ চলার অধিকার যদি আমার থাকে, তাহলে তোমার কর্তব্য হলো আমাকে প্রয়োজনমতো পথ ছেড়ে দেয়া।” সুতরাং একথা বলা যায়, একজনের কাছে যা অধিকার অন্যজনের কাছে তা কর্তব্য।
উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অধিকার ভোগ করতে হলে কর্তব্য সম্পাদন করা অত্যাবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে একজনের অধিকারের পরিধি অন্য সকলের প্রতি কর্তব্যবোধের দ্বারা সীমাবদ্ধ।
কর্তব্য কী বা কর্তব্য বলতে কী বুঝ?
প্রত্যেক নাগরিকের যেমন রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি নাগরিকেরও কিছু অবশ্য পালনীয় কর্তব্য রয়েছে। মূলত অধিকারের বিপরীত রূপ হচ্ছে কর্তব্য। প্রত্যেক নাগরিক তার জীবনকে পরিপূর্ণভাবে বিকাশের জন্য অনেক অধিকার ভোগ করে। এসব অধিকারের বিনিময়ে নাগরিক রাষ্ট্রের প্রতি কতিপয় দায়িত্ব পালন করে। এ দায়িত্বকেই কর্তব্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। কর্তব্য বলতে বুঝায় রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে নাগরিকগণ রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়িত্ব পালন করেন।
কর্তব্য সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
এ. সি. কাপুর (A. C. Kapur) বলেছেন, ““আইনের দ্বারা স্বীকৃত অধিকার ভোগের বিনিময় নাগরিক যেসব দায়িত্ব পালন করেন তাই কর্তব্য। “
অধ্যাপক লাঙ্কি (Prof. Laski) বলেছেন, “কর্তব্য বলতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য কোনকিছু করা বা না করার দায়িত্বকে বুঝায়।”
আর, সি. আগরওয়াল (R. C. Agarwal) এর ভাষায়, “A duty is an obligation to a member of a society of state to observe this obligation of society.”
উইলিয়াম এ. ফ্রাঙ্কেনা (William A. Frankena) এর মতে, “কর্তব্য হচ্ছে এমন এক নীতিনিষ্ঠ আচরণ যা সকল সময়ই মানুষ পালন করতে বাধ্য থাকে।”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, কর্তব্য হচ্ছে অধিকার ভোগের বিনিময়ে নাগরিক কর্তৃক রাষ্ট্রের প্রতি কতিপয় দায়িত্ববোধ। কর্তব্য ও দায়িত্ব বোধ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
অধিকার ও কর্তব্য বলতে কী বুঝ?
একটি রাষ্ট্রকে আধুনিক ও কল্যাণকর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অধিকার ও কর্তব্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিম্নে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক : নিম্নে অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে যে সম্পর্ক তা তুলে ধরা হলো :
১. অধিকারের মধ্যেই কর্তব্যের ধারণা বর্তমান;
২.অধিকারের পরিধি কর্তব্য দ্বারা সীমাবদ্ধ;
৩.রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের উপর নাগরিকের অধিকার নির্ভরশীল।
৪.নৈতিক অধিকার ও নৈতিক কর্তব্য সম্পর্কযুক্ত;
৫. কর্তব্য পালনের উপর অধিকার ভোগ নির্ভরশীল;
৬. কর্তব্য পালনের মাধ্যমে অধিকার অর্জন করতে হয়;
৭. কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অধিকার প্রয়োজন;
৮. সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে অধিকার ও কর্তব্য পরিপূরক।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে যদি সমস্বয়সাধন করা যায় তাহলে রাষ্ট্র যেমন উপকৃত হবে তেমনি হবে ব্যক্তি। কারণ একজন নাগরিক কখন অধিকার ভোগ করে তখন তার উপর কর্তব্য পালন করা আবশ্য জরুরি হয়ে পড়ে।
আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কর্তব্য বলতে কী বুঝ?
আধুনিক রাষ্ট্র কল্যাণকর রাষ্ট্র হওয়ায় জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যেমন অধিকার বেড়েছে, তেমনি রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের কর্তব্যও বেড়েছে। রাষ্ট্র এসব কর্তব্য প্রত্যেক নাগরিকের নিকট প্রত্যাশা করে।
নাগরিকের কর্তব্য : আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের যেসব কর্তব্য তা নিম্নরূপ :
ক. রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন;
খ. রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলা;
গ. ভোট প্রদান করা;
ঘ. সংবিধান মান্য করা;
ঙ. শিক্ষা প্রদান করা;
চ. রাষ্ট্রের সেবা করা;
ছ. সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা;
জ. জনকল্যাণসাধন করা;
ঝ, দেশের সম্পদ রক্ষা করা;
ঞ. শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রের প্রতি তার সব কর্তব্য পুরোপুরিভাবে পালন করে তাহলেরাষ্ট্র ও ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করতে পারবে। কারণ অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর একে অপরের উপর নির্ভরশীল।
আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার বলতে কী বুঝ?
আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকারের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। রাষ্ট্রের উপর নাগরিকদের অনেক অধিকার বিদ্যমান যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
নাগরিক অধিকার : আলোচনার সুবিধার্থে আমরা নাগরিক অধিকারসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে
পারি। যথা :
১. সামাজিক অধিকার;
২. রাজনৈতিক অধিকার;
৩. অর্থনৈতিক অধিকার।
ক. সামাজিক অধিকার : ব্যক্তির যে সমস্ত অধিকার সমাজের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো সামাজিক অধিকার। যেমন-
১. সম্পত্তি লাভের অধিকার;
২. জীবনধারণের অধিকার;
৩. পরিবার গঠনের অধিকার;
৪. জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা লাভের অধিকার।
খ. রাজনৈতিক অধিকার : ব্যক্তির যে সব অধিকার রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত সেগুলো রাজনৈতিক অধিকার। যেমন-
১. ভোটদানের অধিকার;
২. সরকারি কাজে নিয়োগ লাভের অধিকার;
৩. নির্বাচনের অধিকার।
গ. অর্থনৈতিক অধিকার : ব্যক্তির যেসব অধিকার অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত সেগুলোকে অর্থনৈতিক অধিকার বলে। যেমন-
১. কর্ম লাভের অধিকার;
২. ন্যায্য পারিশ্রমিক লাভের অধিকার;
৩. ব্যবসায় বাণিজ্যের অধিকার।
পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তির বিকাশে তিন প্রকার অধিকারই খুব গুরুত্বপূর্ণ। যা সমাজে মানুষের সামাজিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
নৈতিক অধিকার কী বা নৈতিক অধিকার কাকে বলে?
রাষ্ট্রের উপর নাগরিকের দ্বিতীয় যে অধিকার তাহলো নৈতিক অধিকার। এর আইনগত কোন ভিত্তি নেই । নৈতিক অধিকার সামাজিক নীতিবোধ ও বিবেকের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিম্নে নৈতিক অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
নৈতিক অধিকার : নৈতিক অধিকার বলতে বুঝায় মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও ব্যক্তিজীবনের যথাযথ প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা, আদর্শবাদী বা নৈতিক ধারণা অনুসারে মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলি বা ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী বাহ্যিক পরিবেশই হলো নৈতিক অধিকার।
অধ্যাপক লাঙ্কি (Prof. Laski) এর ভাষায়, “Rights in fact are those conditions of social life without which no man can seek, in general, to be himself at his best.”
মূলত নৈতিক অধিকার হচ্ছে সমাজের ন্যায়বোধ ও বিবেকের দ্বারা সমর্থিত পারস্পরিক দাবি। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, যদিও নৈতিক অধিকার আইন দ্বারা স্বীকৃত নয়, তথাপি নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আইনগত অধিকার কী বা আইনগত অধিকার বলতে কী বুঝ?
রাষ্ট্রের অধীনে ব্যক্তির এমন কিছু অধিকার রয়েছে যেগুলো আইন দ্বারা স্বীকৃত, তাদের আইনগত অধিকার বলা হয়। নিম্নে আইনগত অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
আইনগত অধিকার : রাষ্ট্রকর্তৃক আইনের দ্বারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত দাবিদাওয়াকে আইনগত অধিকার বলে।
H. Green এর মতে, “মানুষ রাষ্ট্রীয় সমাজের সভ্য হিসেবেই অধিকার লাভ করতে পারে। কারণ রাষ্ট্রের মধ্যেই দাবিদাওয়ার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ।
অধ্যাপক বোসাংকেত (Prof. Bosanquet) এর মতে, “অধিকার হলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি।” (A right is a claim recognized by society and enforced by the state)
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নাগরিকদের অধিকারসমূহের মধ্যে আইনগত অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । যা রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধন করে।