কর্মী ব্যবস্থাপনার জনক হিসেবে সাধারণত ফ্রেডেরিক উইনসলো টেইলরকে (Frederick Winslow Taylor) বিবেচনা করা হয়। টেইলরের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব বা সায়েন্টিফিক ম্যানেজমেন্ট তত্ত্ব (Scientific Management Theory) শিল্প ও কর্মক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানোর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি কর্মক্ষেত্রের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য তার তত্ত্ব ও পদ্ধতিগুলি প্রবর্তন করেছিলেন। তার জীবন, তত্ত্ব ও অবদানের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
ফ্রেডেরিক উইনসলো টেইলরের জীবনী
ফ্রেডেরিক উইনসলো টেইলর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৬ সালের ২০শে মার্চ, আমেরিকার পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়াতে। তার পরিবার ছিলো ধনী ও সুশিক্ষিত, এবং তারা চাইত টেইলর আইনজীবী হোক। তবে, টেইলর নিজে শিল্প ও প্রকৌশল বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। ১৮৭৮ সালে তিনি মিডভেল স্টীল ওয়ার্কস-এ একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে পদোন্নতি পেয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও ম্যানেজার হন। ১৮৮১ সালে তিনি তার প্রথম গবেষণা শুরু করেন যেখানে তিনি লোহার প্লেট কাটা নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব
টেইলরের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব চারটি মূলনীতি নিয়ে গঠিত:
- বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ: কাজের প্রতিটি অংশ বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে একটি সেরা পদ্ধতি নির্ধারণ করা।
- কর্মী নির্বাচন ও প্রশিক্ষণ: কর্মীদের যথাযথভাবে নির্বাচন করা এবং তাদের কাজের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
- সহযোগিতা ও সমন্বয়: ম্যানেজার ও কর্মীদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ও সহযোগিতা স্থাপন করা।
- কাজ ও দায়িত্বের বিভাজন: ম্যানেজার ও কর্মীদের মধ্যে কাজের দায়িত্ব ও দায়িত্বভাগ স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা।
টেইলরের অবদান
- কারখানা ব্যবস্থাপনা: টেইলর প্রথম ব্যক্তি যিনি কাজের মান উন্নয়নের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। তার পদ্ধতি অনুসারে, কারখানায় কাজের সময় ও গতির বিশ্লেষণ করে, সময় ও গতির মান নির্ধারণ করা হয়।
- মোটিভেশন তত্ত্ব: টেইলরের মতে, অর্থই একমাত্র প্রেরণা নয়, বরং কাজের উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রশিক্ষণও কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- কর্মী প্রশিক্ষণ: টেইলর জোর দিয়েছিলেন যে প্রশিক্ষিত কর্মীরাই ভালো কাজ করতে পারে। তাই তিনি কর্মীদের প্রশিক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
- মান নির্ধারণ ও পুরস্কার: টেইলর প্রস্তাব করেছিলেন যে কাজের মান নির্ধারণ করা উচিত এবং তা অনুযায়ী কর্মীদের পারিশ্রমিক প্রদান করা উচিত। এর ফলে কর্মীরা উৎসাহিত হয় এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার প্রভাব
টেইলরের তত্ত্ব শিল্প বিপ্লবের সময়কার কর্মকৌশলের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। তার পদ্ধতি বিভিন্ন শিল্পকারখানায় গ্রহণ করা হয় এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপ ও এশিয়াতেও জনপ্রিয় হয়। বিভিন্ন দেশে তার তত্ত্ব অনুসারে কাজের প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করা হয়।
টেইলরের সমালোচনা
যদিও টেইলরের তত্ত্ব ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, তবুও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা রয়েছে:
- মানবিক দিক উপেক্ষা: টেইলরের তত্ত্বে মানবিক উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তার মতে, কাজের প্রক্রিয়া ও দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কর্মীদের মানসিক অবস্থার প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
- বৈচিত্র্যের অভাব: টেইলরের পদ্ধতিতে সকল কর্মীকে একইভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, যার ফলে ব্যক্তিগত পার্থক্য ও বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
- প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব: টেইলরের পদ্ধতিতে কর্মীরা ম্যানেজারের নির্দেশ অনুসারে কাজ করে, যা তাদের সৃজনশীলতা ও স্বাধীন চিন্তার উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
টেইলরের উত্তরাধিকার
টেইলরের অবদান এখনও ম্যানেজমেন্ট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তার তত্ত্ব ও পদ্ধতিগুলি আধুনিক ম্যানেজমেন্ট তত্ত্বের ভিত্তি গঠন করেছে। তার গবেষণা ও কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছেন। আজও টেইলরের নাম কর্মী ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াবদ্ধ উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
ফ্রেডেরিক উইনসলো টেইলর একজন প্রতিভাবান ও দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি কর্মী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তার বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব শিল্প ও কর্মক্ষেত্রে একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে এবং তার পদ্ধতিগুলি আধুনিক ম্যানেজমেন্ট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করছে। তার অবদান ও তত্ত্বের মাধ্যমে টেইলর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।