ভূমিকা : শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানের আলো দান করে; শিক্ষাই মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধ জাগিয়ে তোলে। শিক্ষা
মানবজীবনের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। শিক্ষা মানুষের মধ্যে মানবীয় গুণাবলির উদ্বোধন ঘটায়; সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করে, মানুষে-মানুষে শিক্ষায় শিক্ষিত করে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে এবং সভ্যতা গড়ে তুলতে চায় এবং তাদের সুস্থ ও ও সংস্কৃতিকে সুন্দর ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ করে। প্রত্যেক মানুষই তার সন্তানদের উপযুক্ত কামনা করে।
শিক্ষা মানুষকে জীবনের পূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। যথার্থ শিক্ষার অভাব ঘটলে কেউ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। এজন্যে অভিভাবকেরা সন্তানদের শিশুকাল থেকে যথেষ্ট সচেতন থাকে, যাতে তাদেরকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ নাগরিক রূপে সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। শিক্ষাকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায় : সাধারণ শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষা : সাধারণ মানসিক বৃত্তি, চরিত্র গঠন ও জ্ঞান অর্জনের যে শিক্ষা তা-ই সাধারণ শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ কোনো বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা নিয়ে জীবিকা অর্জনের-যোগ্যতা লাভ করে, তা-ই কর্মমুখী শিক্ষা। মানুষ যা কিছু পাঠ্যপুস্তকে পড়ে তা হচ্ছে জ্ঞান বা জানা; পুস্তক থেকে লব্ধ জ্ঞান যখন হাতে-কলমে প্রয়োগ করা হয়, সেটি তখন কর্ম। মানুষকে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শুধু মানুষ হয়ে উঠলেই চলে না, তার অর্জিত শিক্ষা প্রয়োগের মাধ্যমে যাতে দু’মুঠো অন্নের সংস্থান হয়, সেদিকেও তাকে খেয়াল রাখতে হয়। যে শিক্ষা থেকে জীবিকার ব্যবস্থা হয় না, সে শিক্ষার মূল্য নেই। যে শিক্ষা মানুষকে কর্মের সঙ্গে যুক্ত করে তা-ই কর্মমুখী শিক্ষা।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রকারভেদ : কর্মমুখী শিক্ষা দু’রকমের। এক রকমের হলো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ যারা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করে ইচ্ছেমতো স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত থাকে। ডিগ্রি মানুষের জীবকার ব্যবস্থা করে ও নির্বিঘ্নে জীবনযাপনের সুযোগ নিশ্চিত করে। এসব ডিগ্রিধারীদেরকে চাকরির আশায় বেকার জীবন যাপন করতে হয় না। অন্যটি হলো কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা। এ শিক্ষার জন্যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। সাধারণভাবে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ করলেই চলে। এই কর্মমুখী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলে, কাউকে খাওয়া-পরার জন্যে ভাবতে হয় না, কিংবা বেকার জীবনযাপন করতে হয় না। এ জাতীয় শিক্ষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধাত্রীবিদ্যা, দর্জির কাজ, কাঠমিস্ত্রির কাজ, রংমিস্ত্রির কাজ, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ, সেলাই কাজ, বই বাঁধাই কাজ, ছাপাখানার কাজ, বিদ্যুতের স্টিলের সরঞ্জামাদি কাজ, টি-ভি-ফ্রিজ-রেডিও মেরামতের কাজ, অটোমোবাইল মেকানিকের কাজ, ওয়েল্ডিং-এর কাজ, তৈরির কাজ, কারখানায় শ্রমিকের কাজ ইত্যাদি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো পরাধীন যুগের। ইংরেজ আমলের একধরনের কেরানি বানাবার শিক্ষাব্যবস্থা এখনো আমাদের দেশে প্রচলিত। এই গতানুগতিক গ্রন্থগত শিক্ষাব্যবস্থা ডিগ্রিধারী শিক্ষিত তৈরি করলেও এটার দ্বারা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর মানুষের সৃষ্টি হয় না। বর্তমান পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যে নানা কলাকৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে। অথচ ব্যবসায়-বাণিজ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে তথা সামগ্রিক জীবনযাত্রায় আমরা অনবরত পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষার প্রতি একটি প্রবল মোহ অতীতের ঐতিহ্য অনুসরণে আজও বিরাজ করছে। অতীতকালে বিশেষ বৃত্তির ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা সমাজের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থায় অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে জীবনের তেমন যোগাযোগ নেই। ছাত্রছাত্রীদের বহু পরিশ্রমে প্রাপ্ত ডিগ্রির দ্বারা জীবিকার কোনো ভালো ব্যবস্থা হচ্ছে না। শিক্ষিত যুবসমাজ কোনো চাকরিও পাচ্ছে
না। ফলে দিনে দিনে বেকারের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান শিক্ষায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারার যোগ্যতা নেই। আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অনেকের সামনে কোনো কাজ নেই। আমাদের সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক গবেষণা সীমিতসংখ্যক লোককে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দিচ্ছে, কিন্তু জীবনের নানা কাজের জন্যে প্রয়োজনীয়সংখ্যক যোগ্য লোক তৈরি করছে না। এ দুরবস্থার মূল কারণ, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী নয়। তাই বর্তমানে এ দেশে উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তাদের অর্জিত শিক্ষা উৎপাদনমুখী নয় বলে তাদের জন্যে কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে কর্মমুখী শিক্ষা সম্প্রসারণ করা অতি আবশ্যক।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার ও দারিদ্র্যের কারণে এ দেশে বেকার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। দেশে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। জাতীয় জীবনে এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করে তোলা দরকার। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি এমন কর্মমুখী শিক্ষা দরকার, যা গ্রহণ করে জীবিকার সুযোগ লাভ করা যায়। বহু ছাত্রছাত্রী স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করতে এসে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এরূপ স্কুল, কলেজ পরিত্যাগকারী অনেক ছাত্রছাত্রী জীবনে বেকারত্বের কবলে পড়ে জাতীয় অর্থনেতিক সমস্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্যেও কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষার প্রচলন শিক্ষার্থীদেরকে পছন্দমতো কোনো না কোনো পেশা গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করার পর কাউকে চাকরির জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না। এ শিক্ষা দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। দেশের দারিদ্র্যমোচন করে অর্থনৈতিক
স্থিতিশীলতা আনতে কারিগরি শিক্ষা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ শিক্ষা আয়-উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়। কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব যত বেশি দেওয়া যাবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তত সুদৃঢ় হবে। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়।
বাংলাদেশ ও কর্মমুখী শিক্ষা : বর্তমানে পৃথিবীতে কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার লক্ষ করা যায়। উন্নত দেশসমূহে এ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। বিজ্ঞান শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে সেসব দেশে কর্মমুখী শিক্ষার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার বহু কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় উচ্চতর পর্যায়ে লেখাপড়ার সুবিধার্থে দেশে অনেক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব ইনস্টিটিউটে নানা
পেশাভিত্তিক কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কতকগুলো ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট আছে যেখানে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে দেশে সরকার বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে বহু কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে সরকার ও বেসরকারি জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আরো অনেক কর্মমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কুটির শিল্প, বয়ন শিল্প, ডেইরি শিল্প শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া, পাটকল, চিনিকল, ইস্পাত শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদিতে কাজ করা যোগ্য ও দক্ষ কারিগর তৈরিতে সহায়ক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ওপরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। এরূপে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ সম্ভব হলে জাতি উন্নয়নের দিকনির্দেশনা লাভ করবে।
উপসংহার : দেশের ছাত্রসমাজকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কেবল কেরানি, উকিল, শিক্ষক কিংবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। জাতীয় অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন কর্মের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দরিদ্র দেশে জনগণকে বেকার বসিয়ে রাখা সমীচীন হবে না। স্বদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও উন্নত বিশ্বের প্রগতির ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলার জন্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবনমুখী করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। একমাত্র কর্মমুখী বা কারিগরি শিক্ষাই দেশ ও জাতির উন্নয়ন, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। তাই ডিগ্রি অর্জনের মিথ্যা মোহ পরিহার করে কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বেকারত্বের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।