আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র একটি সর্বজন স্বীকৃত শাসনব্যবস্থা। আদর্শ হিসেবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যে গ্রহণযোগ্য সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ঐকমত্য থাকলেও গণতন্ত্রের সাফল্য এমনি এমনি আসে নি। গণতন্ত্রের সঠিক ও সার্থক প্রয়োগ কতকগুলো শর্তের উপর নির্ভরশীল।
গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি : নিম্নে গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি আলোচনা করা হলো :
১. গণতান্ত্রিক পরিবেশ : মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী পরিবেশই হলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ। এর জন্য প্রয়োজন সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের সংরক্ষণ। কেননা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে।
২. আইনের শাসন : গণতন্ত্রের সফলতার পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইনের চোখে সাবাইকে সমানভাবে দেখতে হবে। তাহলে গণতন্ত্র সফল হবে।
৩. উপযুক্ত শিক্ষা : শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারকে গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। আর জনগণ যদি অধিকাংশ অশিক্ষিত হয় তাহলে তাদের পক্ষে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন সম্ভব হয় না। ফলে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়।
৪. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। কেননা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলে জনগণ ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় ।
৫. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রয়োজন রয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্বরূপ ও সার্থকতা সঠিকভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য জনসাধারণকে সাহায্য করে।
উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার কারণ সংক্ষেপে আলোচনা
বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। কেননা এখানে জনগণের মতামতের প্রাধান্য বিদ্যমান। এই শাসনব্যবস্থায় জনগণ নিজেই বুঝতে পারে কিভাবে চললে তার কল্যাণ হবে এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ হবে। তবে এ সময়ে এসেও আজ উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্র অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ। গণতন্ত্র সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারছে না। গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার কারণ : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন কারণে তন্ত্র ব্যর্থ। নিম্নে গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার কারণ
আলোচনা করা হলো :
১. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য দরকার শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল । কিন্তু অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব রয়েছে।
২. শিক্ষার অভাব : গণতন্ত্র হচ্ছে অধিকাংশ জনগণের মতামতের সমষ্টি। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে অধিকাংশ জনগণ অশিক্ষিত হওয়ার ফলে তারা দক্ষ প্রতিনিধি নির্বাচনে ব্যর্থ। ফলে গণতন্ত্র ব্যাহত হচ্ছে।
৩. সামরিক হস্তক্ষেপ : উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় সমস্যা সামরিক হস্তক্ষেপ।উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঘন ঘন সামরিক শাসনের ফলে গণতন্ত্র তার নিজ পথে অগ্রসর হতে পারছে না।
৪. অর্থনৈতিক সংকট : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ফলে তারা নিজেদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে ব্যস্ত। ফলে গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে তাদের কোন ভূমিকা থাকে না।
৫. উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব : গণতন্ত্র সফলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব। কিন্তু অধিকাংশ উন্নয়শীল দেশের রাজনীতি অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্বের হাতে ন্যস্ত।
৬. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অভাব : উন্নয়নশীল দেশগুলো সুদীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে তাদের অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভব হয় নি। ফলে গণতন্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়।
গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ সংক্ষেপে আলোচনা
বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান সব ধরনের শাসনব্যবস্থার মূলকথা হলো জনস্বার্থ রক্ষা। আর জনগণের কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। এখানে সরকার গঠিত হয় জনগণের দ্বারা, সরকার পরিচালিত হয় জনগণের দ্বারা এবং সরকার জনগণের স্বার্থে কাজ করে।
গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ : নিম্নে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা : গণতন্ত্র হলো একমাত্র শাসনব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা হয় এবং
ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। গণতান্ত্রিক শাসনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা।
২. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : গণতন্ত্র হলো ন্যয়নীতি ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বার্কারের মতে, ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব।” তাই গণতন্ত্রকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপযোগী শাসনব্যবস্থা বলা হয় ।
৩. আইনের অনুশাসন : গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্রে একমাত্র আইনের যথাযোগ্য মর্যাদা
দেয়া হয়। আইনের দৃষ্টিতে ধনী, গরিব, নারী-পুরুষ সবাই সমান। গণতন্ত্রে জনগণই হলো চূড়ান্ত বিচারক।
৪. শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। এ শাসন ব্যবস্থায় শাসক তার শাসনকার্য পরিচালনা করে জনমতের উপর ভিত্তি করে।
৫. সাম্য, মৈত্রি ও স্বাধীনতার উপস্থিতি : গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ এটি সাম্য, মৈত্রি ও স্বাধীনতার মূল
ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতন্ত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, নির্বিশেষে সকলেই আইনের চোখে সমান।
৬. দায়িত্বশীলতা : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসিতে রয়েছে শাসক দায়িত্বশীল থাকে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায়
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ তাদের কাজের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকেন। আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায়ও রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকেন।
গণতন্ত্রের গুণাবলি
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় গণতন্ত্র একটি বহুল আলোচিত বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্র নতুন কোন বিষয় নয়। প্রাচীনকাল থেকেই গণতন্ত্রের ধারণা প্রচলিত এবং যুগে যুগে মানুষ গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করে আসছে। এ কারণে বর্তমানে গণতন্ত্র সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত |
গণতন্ত্রের সুবিধা : আধুনিক শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বহুবিধ সুবিধা চোখে পড়ে। নিম্নে গণতন্ত্রের গুণাবলি বা
সুবিধা আলোচনা করা হলো :
১. দেশপ্রেমের সৃষ্টি : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকে এবং সকলের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। তাই সরকারকে তারা নিজেদের মতো দেখে। ফলে জনগণের মাঝে দেশপ্রেমের জন্ম নেয়।
২. আইনের শাসন : গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো আইনের শাসন। তাই গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে সকল ক্ষেত্রে জনগণই চূড়ান্ত বিচারক। ফলে সকল বৈষম্যমূলক আচরণের পথ বন্ধ থাকে।
৩. সর্বসাধারণের কল্যাণ : গণতন্ত্র যেহেতু জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার, জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করা হয় এবং সকল ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থ বা অধিকার রক্ষিত হয়। তাই এখানে
৪. স্বৈরাচারিতা রোধ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা কম। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থা হলো জনমত দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। জনগণের ভয়ে সরকার স্বৈরাচারী আচরণ থেকে বিরত থাকে।
৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনব্যবস্থা পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা সকলেই ভোগ করার সুযোগ পায়, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।
গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য
পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র । আর সবচেয়ে নিকৃষ্টি শাসনব্যবস্থা হচ্ছে একনায়কতন্ত্র। বাস্তবতার আলোকে এই দুই শাসনব্যবস্থা দুই মেরুতে অবস্থিত। গণতন্ত্রকে যেমন মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ মনে করা হয় তেমনি একনায়কতন্ত্রকে মানবজাতির জন্য অভিশাপ মনে করা হয়। গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য : গণতন্ত্র ও একনায়তন্ত্রের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় :
১. ক্ষমতার উৎস : গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন। এখানে সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। অপরদিকে একনায়কতন্ত্র হলো একজনের শাসন। একনায়কতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস হচ্ছে এক ব্যক্তি বা দলীয় চক্র।
২. ব্যক্তিস্বাধীনতা : গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা। গণতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষিত হয়। অপরদিকে একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষিত হয় না।
৩. আইনসভা : গণতন্ত্রে সরকারে মূল আলোচনার কেন্দ্র হলো আইনসভা। আইনসভা দেশের প্রয়োজনে জরুরি আইন প্রণয়ন করে । অপরদিকে, একনায়কতন্ত্রে আইনসভা প্রহসনমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
৪. নির্বাচনের ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকগণ জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকেন। কিন্তু অপরদিকে একনায়কতন্ত্রে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্থলে প্রহসনমূলক নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়।
৫.আইনের শাসন : গণতন্ত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কেননা গণতান্ত্রিক সরকার আইন অনুবর্তন ছাড়া কোন কার্য পরিচালনা করতে পারে না। অপরদিকে একনায়কতন্ত্রে আইনের শাসনের বালাই নেই । শাসক শ্রেণির কথাই আইন।
একনায়কতন্ত্রের ইতিবাচক দিক
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। তেমনি একটি শাসনব্যবস্থা হলো একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এখানে একজন ব্যক্তি শাসন ক্ষমতায় নিয়োজিত থাকেন এবং তিনি একাই সকল কাজ
পরিচালনা করেন । ফলে কাজের ক্ষেত্রে যেমন সময় কম লাগে তেমনি কাজের জটিলতা হ্রায় পায় ।
একনায়কতন্ত্রের সুবিধা : নিম্নে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুবিধা/গুণাবলি/ইতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. যোগ্যতার কদর : একনায়কতন্ত্রে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা যোগ্যতার বিচারে সরকারি আনুকূল্য লাভ করেন। ফলে
জাতীয় জীবনে সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত হয়।
২. জরুরি অবস্থার উপযোগী : একনায়কতন্ত্র জরুরি অবস্থার উপযোগী। একনায়কতন্ত্রে সকল ক্ষমতা একজনের হতে থাকে বিধায় শাসক জরুরি মুহূর্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা গণতন্ত্রে সম্ভব নয়।
৩. স্থায়িত্ব : সরকারের স্থায়িত্ব একনায়কতন্ত্রের বিশেষ গুণ। গণতন্ত্রে জনমতের পরিবর্তনের ফলে সরকারের ঘন ঘন পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে সরকারের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব বজায় থাকে।
৪. ব্যয় সংকোচন : একনায়কতন্ত্রে প্রশাসনিক দায়িত্ব একজনের হাতে ন্যস্ত থাকায় প্রশাসনিক কাজ সম্পাদনে অর্থ ব্যয় কম হয়। এতে অহেতুক ব্যয় পরিহার করা হয়।
৫. দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক : একনায়কতন্ত্রের একনায়ক চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
৬. প্রগতিশীল : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দক্ষ ও শিক্ষিত এবং বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃক শাসনকার্য পরিচালিত হয়। এ জন্য খুব সহজেই পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শাসনকার্য পরিচালিত হয় যার ফলে এটি সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থা।
একনায়কতন্ত্রের অসুবিধাসমূহ কী কী?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে একনায়কতন্ত্র নতুন কোন বিষয় নয়। তত্ত্বগতভাবে একনায়কতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা। প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমে একনায়কতন্ত্রের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। একনায়কতন্ত্রের কিছু সুবিধার পাশাপাশি অনেক অসুবিধাও রয়েছে, যা শাসনব্যবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করে ।
একনায়কতন্ত্রের অসুবিধা : নিম্নে একনায়কতন্ত্রের অসুবিধা/দোষ/ নেতিবাচক দিকসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. জনমত উপেক্ষিত : একনায়কতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো জনমত উপেক্ষিত। এখানে জনগণের
মতামতের কোন প্রাধান্য থাকে না। শাসক নিজের মতো শাসন পরিচালনা করে।
২. ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী : একনায়কতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী। এ শাসনব্যবস্থায় শাসকই চূড়ান্ত ক্ষমতার
অধিকারী। জনগণকে বলা হয় বিশ্বাস কর, মান্য কর, যুদ্ধ কর।
৩. আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন : একনায়কতন্ত্রে একনায়কই হলো সর্বেসর্বা। তার উপর কোনো কথা চলে না। তার নির্দেশই আইন। এ শাসনব্যবস্থায় নামেমাত্র একটি আইনসভা ও বিচার বিভাগ থাকে। এর কোন স্বাধীনতা থাকে না।
৪. মিথ্যা প্রচার : মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমেই একনায়কতন্ত্রের শাসন পরিচালিত হয়। বেশিরভাগ সময়ই শাসক জনগণকে বিভ্রান্তির কবলে ফেলে দিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন।
৫. স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নেই : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ নেই। ফলে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে জনগণ উদাসীন থাকে।
৬. অর্থের অপচয় : একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিপ্লবের আশঙ্কা থাকায় একনায়ককে বিশাল গুপ্তচর বাহিনী ও বৃহৎ সেনাবাহিনী গঠন করতে হয়। এসব খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার ফলশ্রুতিতে বলা যায়, একনায়কতন্ত্রের যেসব অসুবিধা পরিলক্ষিত হয় তাতে একনায়কতন্ত্র পরিত্যাজ্য। কারণ আধুনিক গণতন্ত্রেই একমাত্র জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়।
একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ কী?
যে সরকার বা শাসনব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে। অন্যভাবে বলা যায় কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি যখন অবাধে শাসন ক্ষমতা অর্জন ও ব্যবহার করতে পারে তখনই একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর প্রতিটি সরকার ব্যবস্থার কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তেমনি একনায়কতান্ত্রিক সরকারের রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য : একনায়কতন্ত্রের আদর্শ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নিম্নের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় :
১. ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী : একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা স্বীকার করা হয় না।জনসাধারণকে বলা হয় To believe, to obey, to fight. এখানে ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোন ধরনের অধিকার স্বীকার করা হয় না।
২. বলপ্রয়োগ : একনায়কতন্ত্রে জনগণের মতামত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা হয়। বিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন
করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ব্যবস্থায় সকল ক্ষেত্রেই দমননীতিকে প্রাধান্য দেয়া হয় ।
৩. একদল, একনেতা : এ শাসনব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। কোন বিরোধী দলের অস্তিত্ব এখানে
সহ্য করা হয় না। আর এ একদলের একজন নেতা থাকেন। তার নির্দেশিত পথেই সবাইকে চলতে হয়। তার বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা কারো নেই।
৪. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ : ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ একনায়কতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নির্বাহী বিভাগ একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এবং সাংবিধানিক কোন বাধানিষেধ একনায়কতন্ত্রে থাকে না ।
৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রোধ : একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রনায়ক হলেন সর্বেসর্বা। এখানে বিচার বিভাগ থাকে, কিন্তু বিচার বিভাগের কোন স্বাধীনতা নেই। রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশই আইন। তিনি বিচার কাজে হস্তক্ষেপ করেন।
পরিশেষে বলা যায় দেশের শাসনক্ষমতা যখন কোন একজন স্বৈরশাসনের হাতে থাকে তখন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। একনায়কতন্ত্রের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তাতে বুঝা যায় এটি জনগণের জন্য কাম্য নয়।
একনায়কতন্ত্রের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
যে সরকার বা শাসনব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা কোন একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে থাকে। তাকে একনায়কতন্ত্র বলে। অন্যভাবে বলা যায়, কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি যখন অবাধে শাসনক্ষমতা অর্জন ও ব্যবহার করতে পারে তখনই একনায়কতন্ত্রের বা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের সৃষ্টি হয়। একনায়কতান্ত্রিক সরকার আবার কয়েক ধরনের হয়ে থাকে।
একনায়কতন্ত্রের শ্রেণিবিভাগ : শাসক ও শাসন পদ্ধতির বিভিন্নতা লক্ষ্য করে একনায়কতন্ত্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. ঐতিহ্যবাহী শাসন: সৌদি আরবে এই ধরনের স্বৈরতন্ত্রী শাসন দেখা যায়। ঐতিহ্য ও সনাতন ভাবধারার প্রতি
অনুগত কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এই ব্যবস্থায় শাসন কর্তৃত্ব ভোগ করেন।
২. ধর্মীয় শাসন : বহু দেশে ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুশাসনকে ভিত্তি করে বহু একনায়ক শাসন করেন। এশিয়া ও
মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের শাসন দেখা যায়।
৩. সামরিক শাসন : সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেক শাসক একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। নাইজিরিয়া, মিশর,
পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে সামরিক বাহিনীর নেতারাই প্রত্যক্ষ প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করেন।
৪. দলীয় স্বৈরতন্ত্র : অভিভক্ত জার্মানিতে হিটলারের নাৎসীবাদী শাসন এবং ইতালিতে মুসোলিনীয় ফ্যাসীবাদী শাসন দলীয় স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের উদাহরণ।
৫. আধাসামরিক শাসন : পূর্ণ সামরিক নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী সাময়িকভাবে ক্ষমতা দখল করেছে এবং কিছুকাল পরে ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করেছে।