ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটিকে গড়ে তোলার সংগ্রাম চলছে। দীর্ঘ ৪৫ বছর পরও আজো এ দেশ উন্নয়নশীলতার গণ্ডি অতিক্রম করতে পারে নি। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণ বিশ্ব যেখানে আজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে সেখানে নানা কারণে আমরা এখনো পেছনে পড়ে আছি। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করা। সকল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তি যুক্ত করতে পারলে এদেশ অচিরেই ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ কী : ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে বোঝায়, সারাদেশের সকল কর্মকাণ্ডকে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সিস্টেমের মাধ্যমে গতিশীল করে তোলা। একটি দেশকে তখনই ডিজিটাল বলা যাবে, যখন তা সব দিক দিয়ে ই-স্টেট (e-state)-এ রূপান্তরিত হবে। অর্থাৎ, দেশের সরকার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি ইত্যাদি যাবতীয় কার্যাবলি কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরিচালিত হলেই তাকে ব-ংঃধঃব বলা যায়। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো যথাযথরূপে অনুসরণ করতে পারলেই বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বলা যাবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও হাইওয়েগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে এক জায়গায় অবস্থান করে দেশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরূপ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড ও বাইরের পৃথিবীকে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশ যে অবস্থানে পৌঁছবে, তাকেই আমরা বলতে পারবো ডিজিটাল বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে দেশের সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার ও জনগণের অনেক কিছু করণীয় আছে। ইতোমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের নানা সাফল্য উপভোগ করতেও সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো সাফল্যের জন্য যা দরকার তা নিচে আলোচনা করা হলো :
শিক্ষাক্ষেত্রে : জাতির জীবনের উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্যে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রথমেই শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টরের সাহায্যে শিক্ষকের বক্তব্য ও আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহ দেওয়ালে সাদা পর্দায় প্রদর্শন করা যায়। কোনো শিক্ষক অসুস্থ থাকলে তাঁর লেকচার ভিডিও করে এভাবে কাজ সম্পন্ন করা যায়। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে এ পদ্ধতিতে ঘরে বসেই শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। লাইব্রেরিতে না গিয়েও ইন্টারনেটের ওয়েব সাইট থেকে খুঁজে নিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় পড়ে ফেলা সম্ভব। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশে আংশিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ পদ্ধতি সর্বজনীন করতে হলে ব্যাপক সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে: অর্থনৈতিক উন্নতির মূল চাবিকাঠি হলো গতিশীল যোগাযোগ ব্যবস্থা। যে দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত, সে দেশ অর্থনীতির দিক থেকে তত উন্নত। বর্তমানে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাহায্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগের অনেক কিছুই নিয়ন্ধিত হচ্ছে। মহাশূন্যে বিভিন্ন গ্রহের উদ্দেশ্যে রকেট উৎক্ষেপণ করা হলে যোগাযোগ থাকছে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সঙ্গে। আকাশ পথের মতো সমুদ্রপথও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কম্পিউটারের সাহায্যে। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ অতি সহজেই স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে: চিকিৎসা মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা। বিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি চিকিৎসা ক্ষেত্রে নানা বিস্ময়ের জন্য দিয়েছে। যন্ত্রের সাহায্যে বর্তমানে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতিও অনেক সহজ ও কার্যকর হয়েছে। বিজ্ঞানীদের সাধনায় বহু জটিল রোগের ঔষধ আবিষ্কৃত হচ্ছে। ইন্টারনেটের সুবিধার কারণে দেশে-বিদেশে বড় ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা, সিরিয়াল পাওয়া কিংবা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসা-পরামর্শ লাভ করার এখন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে সরাসরি উপস্থিত না হয়েও ডাক্তারের ফি পরিশোধ করা এখন সম্ভব।
কৃষি ক্ষেত্রে: বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে কৃষিক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিজ্ঞানের বদৌলতে উন্নত জাতের বীজ, সার ও উচ্চ ফলনশীল প্রজাতির শস্য উদ্ভাবিত হয়েছে। কিন্তু কৃষক সমাজের অধিকাংশ নিরক্ষর হওয়াতে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাদির সফল ব্যবহার করতে পারছে না। প্রয়োজনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওয়েব সাইট থেকে বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধান করে জেনে নিয়ে, তা কাজে লাগাতে পারে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে কৃষিক্ষেত্রে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা সৃষ্টি হবে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা : বাংলাদেশের শিক্ষা, ব্যবসা, প্রশাসন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য জনগণ এখন অত্যন্ত সচেতন। সরকারও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পক্ষে ক্রমাগত নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। সর্বক্ষেত্রে, পরিপূর্ণরূপে সফল হতে না পারলেও অনেক জায়গায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আংশিক ডিজিটাল সুযোগ প্রবর্তনে সার্থকতা অর্জন করেছে। প্রকাশনার ক্ষেত্রে আগে একটি বই ছাপিয়ে প্রকাশ করতে মাসের পর মাস সময় লাগত। কম্পিউটার সুবিধার ফলে এখন মাত্র কয়েকদিনে বই-পুস্তক বের করা যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন সংবাদপত্র প্রকাশও সহজতর হয়েছে। অনলাইনে বর্তমানে একটি সংবাদপত্র একসঙ্গে কয়েকস্থান থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। ওয়েবসাইট ব্যবহারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি সংবাদপত্র আজকাল কম্পিউটারে পড়ে নেওয়া সম্ভব। কম্পিউটারের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা অনেক গতিশীল হয়েছে। বহু ব্যাংকে অনলাইন পদ্ধতি চালু আছে। ফলে, টাকা পাঠানোর কাজ অনলাইনে সমাধা করা যায়। অফিস-আদালতে ব্যাপক হারে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করলে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন করা সহজ হবে। বিনোদনের ক্ষেত্রে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে খেলা, সভা-সমাবেশ, নির্বাচন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা সরাসরি দেখানো যেতে পারে। আমাদের জীবনে ক্রয়বিক্রয় একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বর্তমানে বাজারে না গিয়ে ঘরে বসে ক্রয়-বিক্রয় করা ও মূল্য পরিশোধ করা সীমিত পরিসরে সম্ভব হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অন্তরায় : ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারলে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে অনলাইন প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত হবে। দ্রুত ও কার্যকর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সুশাসিত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও নিশ্চয়তা দেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ পেতে হলে একটি কঠিন বাস্তবতা অতিক্রম করতে হবে। এক্ষেত্রে সাফল্যের মূল ভিত্তি হল একটি শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো। এ কাঠামো যথাযথভাবে নির্মাণ করতে গেলে কিছু আনুষঙ্গিক বিষয় দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। যেমন-
(ক) ইংরেজি শিক্ষার হার : এটা সত্য যে, মূলত ইংরেজি ভাষা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বায়ণকে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু, বাংলাদেশে ইংরেজিতে শিক্ষিতের হার অত্যন্ত কম। এজন্য, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা যায় নি। এখন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের স্বার্থে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে।
(খ) বিদ্যুৎ ঘাটতি : বাংলাদেশকে প্রতিদিন বিরাট বিদ্যুৎ ঘাটতির মুখোমুখি হতে হয়। একটি পরিপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো গড়ে তুলতে হলে কিন্তু পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন একান্ত প্রয়োজন।
(গ) ইন্টারনেট ব্যবহার : একটি দেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য সে দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচুতে।
(ঘ) সাবমেরিন ক্যাবল : বাংলাদেশ ২০০৬ সাল থেকে সমুদ্র তলদেশের সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু একটিমাত্র সাবমেরিন ক্যাবল বলে প্রায়ই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশের উপযোগিতা : কম্পিউটার, ডিজিটাল টেলিফোন, ইন্টারনেট সুবিধা প্রভৃতি তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমগুলো দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে বিস্তৃত করাই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তত্ত্বের লক্ষ্য। তথ্যপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মানুষকে বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, ব্যবসায়-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা বেড়ে যাবে। ফলে, এসব ক্ষেত্রে সময় বাঁচবে, খরচ বাঁচবে এবং শ্রমশক্তির অপচয় হ্রাস পাবে। শিক্ষাক্ষেত্রে নিত্যনতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান উদ্ভাবিত হবে। শিক্ষার্থীরা এই নতুন ধারার সঙ্গে যুক্ত হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ড্যাটাবেজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের প্রচেষ্টা বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে এদেশের চেহারাই বদলে যাবে। বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি দ্রুত প্রসারের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহির্বিশ্বে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সাবমেরিন ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে বেশিরভাগ জনগণই ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে দূরে আছে। শুধু নগরজীবনে কিছু উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত আছে। ইন্টারনেট কাঠামোর উন্নয়ন করতে হলে এর ব্যয় সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে এনে সকলের জন্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার : ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এদেশের মানুষের এক স্বপ্নের নাম। এ স্বপ্ন পূরণের আশা করলে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রের কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ব। এ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। বাংলাদেশ একদিন ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হবে—এটি সকলেরই প্রত্যাশা। সরকার ও জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অচিরেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।