ঢাকার যানজট : সমস্যা ও সমাধান

রচনা

ভূমিকা : ‘যান’ শব্দের অর্থ বাহন। যান বা বাহন হচ্ছে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। এই গতিশীল বিশ্বের প্রতিটি দেশের উন্নতি সুষ্ঠু যানবাহনব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। জনগণের যাতায়াত ও মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্য প্রয়োজন পড়ে সুষ্ঠু যানবাহনব্যবস্থার। এই যানবাহনে জট লেগে কোথাও বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হলে জনজীবনের গতিময়তা বাধাগ্রস্ত হয়। কোনো শহরের রাস্তায় বা সড়কে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের গাড়ি জড়ো হয়ে যানবাহনের

প্রচণ্ড ভিড়ে জনজীবন অচল হয়ে পড়াকে যানজট বলে। বর্তমানে বড় বড় শহর বা নগরে যানজট একটি ভয়ংকর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এই যানজট সমস্যা অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
ঢাকার যানজটের স্বরূপ : ঢাকার জনগণ ঘর থেকে বের হলে কখন যে গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছবে তা জানে না। রাস্তায় কখন যে যানজটে আটকে যাবে এবং কখন যে গাড়ির চাকা আবার সচল হবে আগে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালতে যাবার ও ফিরে আসার পিক্ আওয়ারে বড় বড় রাস্তাগুলোতে ভয়াবহ যানজট লেগেই থাকে। আধঘণ্টার দূরত্বের জন্যে জনগণকে তিন ঘণ্টা হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। স্কুল, কলেজ, অফিস, হাসপাতাল, রেলস্টেশন, বিমানবন্দর, স্টিমার-ঘাট, সভা-সমিতি কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে যথাসময়ে পৌঁছা এখন কোনো রকমেই সম্ভবপর নয়।

ঢাকার যানজট

৫. ঢাকা শহরে রিকশা ও অটোরিকশা অধিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। এখানে সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী বৈধ
লাইসেন্সধারী রিকশার সংখ্যা প্রায় পঁচাশি হাজার। অথচ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় ঢাকার রাস্তাগুলোতে বর্তমানে প্রায় লক্ষ রিক্সা চলাচল করে। রিকশা-অটোরিকশার এই সংখ্যাবৃদ্ধি ও যানজট সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ।
৬. ফুটপাতের অবৈধ দখল ও রাস্তাগুলোর অপব্যবহারের ফলেও যানজট সমস্যা জন্ম নেয়। অবৈধ দখলদাররা ফুটপাতের ওপর অস্থায়ী দোকানপাট বসিয়ে ব্যবসা চালায়। অনেকেই আবার রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী, জঞ্জাল, রাবিশ ইত্যাদি ফেলে রেখে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। যানজটের এটিও একটি বড় কারণ।
৭. ঢাকা শহরে বিল্ডিং কোড না মেনে বহু বাড়িঘর, টাওয়ার, উঁচু বাণিজ্যিক ভবন, শপিং কমপ্লেক্স, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক নির্মিত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এসব দালান-ইমারতের অনেকগুলোতে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এসব ভবনে আগত গাড়ির মালিকেরা রাস্তার পাশে গাড়ি পার্কিং করতে বাধ্য হয়। ফলে এ সকল জায়গায় যানজট সমস্যা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছে।
৮. আমাদের শহরগুলোতে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের ফলে কখনো গ্যাস লাইন, কখনো
টেলিফোন ক্যাবল লাইন, কখনো ওয়াসা লাইন, কখনো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদির কারণে সারা বছর ধরেই রাস্তা
কাটাকাটি বা সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলতেই থাকে। ঢাকা শহরেও এর ব্যতিক্রম নেই। এখানে বানজটের এটিও একটি
কারণ।
৯. গাড়িচালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিযুক্ত যানবাহন চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ট্রাফিক পদ্ধতি অনুযায়ী রাস্তার ডিজাইন না থাকা, ট্রাফিক পুলিশের কর্তব্যে অবহেলা ইত্যাদিও যানজট সমস্যার জন্যে দায়ী।
১০. ঢাকা শহরে পর্যাপ্তসংখ্যক আন্ডারপাস ও ফ্লাইওভার নেই। ওভারব্রিজ যেগুলো আছে সেগুলো ব্যবহারেও জনগণের প্রবল অনীহা। ফলে পথচারীরা ব্যস্ত রাস্তা সরাসরি পারাপার করে বলে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
১১. সড়ক ও জনপদ বিভাগ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন ও রাজউক-এর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে সিটি প্ল্যানিং যথাযথভাবে সম্পাদিত হয় না। ফলে প্রয়োজনীয় ফাঁকা জায়গা, গাড়ি পার্কিং এলাকা ও ফুটপাত না রেখেই সিটি প্ল্যানিং হয়। তাছাড়া, বহু জায়গায় রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার না থাকায় যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এতেও যানজট লেগে যায়।
১২. অশিক্ষিত গাড়িচালকদের প্রতিযোগিতার মনোভাব ও ওভারটেকিং প্রবণতার কারণেও যানজট সৃষ্টি হয়ে থাকে।
১৩. রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলের কারণেও যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে।
১৪. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে স্কুলের ছাত্রছাত্রী, গার্লস্ গাইড, স্কাউটদেরকে বড় আকারের ব্যানারসহ সড়ক প্রদক্ষিণ করতে দেওয়া হয়। এতে যানজট লেগে যায়।


যানজটের ক্ষতিকর প্রভাব : রাজধানী শহর ঢাকায় অফিস, বাজার বা অন্য কোথাও যাবার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে কেউ একবার বের হলে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পারবে কি না তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। নাগরিক জীবনে যানজটের প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ। কোনো কাজে বের হবার দরকার হলে যানজট মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হতে হয়। যানজটের কারণে জনগণকে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে গিয়ে বহু কর্মঘণ্টা নষ্ট করতে হয়। রোগীবাহী পরিবহন ও ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় যানজট। ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজের সময়মতো পৌঁছা, সভা-সমাবেশ, পরীক্ষা ও চাকরির ইন্টারভিউতে ঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয় না। যানজটের কবলে পড়লে বহু সময় ট্রেন কিংবা বিমান ধরা হয়ে ওঠে না। যানজটের শিকার হয়ে অ্যাম্বুলেন্সের রোগী রাস্তায় মারা যেতে পারে
এবং ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি পৌঁছতে বিলম্ব হলে কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে ও বহু প্রাণহানি ঘটতে পারে।
প্রতিকারের উপায় : প্রত্যেকে সততা, আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে অগ্রসর হলে যানজট থেকে মুক্তি লাভ করা খুব কঠিন কাজ নয়। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে কতিপয় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-
১. নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরাতন রাস্তা সংস্কার ও সংকীর্ণ রাস্তাগুলোর প্রসারতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. বড় সড়কগুলোতে রিকশা নিষিদ্ধ করতে হবে। গরুরগাড়ি ও ঠেলাগাড়ির চলাচল উঠিয়ে দিতে হবে।
৩. রাস্তার পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও রাস্তায় নির্মাণ সামগ্রী রাখা নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪. অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফ্লাইওভার, ওভারব্রিজ ও বাই লেন বৃদ্ধি করে রাস্তার ডিজাইন সুবিন্যস্ত করতে হবে।
৫. রাস্তায় আন্ডারপাস নির্মাণ করতে হবে।
৬. ভবিষ্যতে পাতালরেল চালু করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

৭. ধীরগতির যানবাহনের জন্য ভিন্ন রাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. বাণিজ্যিক এলাকায় গাড়ি পার্কিং-এর জন্য জায়গা নির্দিষ্ট থাকতে হবে। রাস্তার ওপরে যেখানে সেখানে গাড়ি
পার্কিং নিষিদ্ধ করতে হবে।
৯. ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করতে হবে।
 ১০. দিনের বেলায় ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
১১. দূরপাল্লার গাড়িকে শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
১২. টেম্পু, ভুটার ও টাউন সার্ভিস বাসের জন্য উপযুক্ত স্থানে পৃথক পৃথক স্ট্যান্ড নির্মাণ করতে হবে।
১৩. শহরে অপরিকল্পিতভাবে যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বা মেরামত করা বন্ধ করতে হবে।
১৪. ওয়াসা লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, গ্যাস লাইন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে রাস্তা খোঁড়ার প্রয়োজন হলে সকল
কর্তৃপক্ষকে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে উক্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
১৫. প্রয়োজনীয়সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগে ট্রাফিক পুলিশকে সক্রিয় থাকতে হবে।
১৬. রাস্তার ওপর সভা-সমাবেশ করা, গাড়ি মেরামত করা, নির্মাণসামগ্রী জমা করে রাখা ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে।
১৭. রাস্তা পারাপারে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
১৮. জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে গ্রামে বেকার হয়ে যাওয়া লোকজন শহরমুখী না হয় এবং গ্রামেই যেন তারা জীবিকার সংস্থান খুঁজে পায়।


যানজট নিরসনে গৃহীত উদ্যোগ : ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে সরকার ইতোমধ্যেই কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ঢাকার পরিবেশ উন্নয়ন ও নাগরিক জীবনের সমৃদ্ধি সাধনের লক্ষ্যে ‘ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সাম্প্রতিককালে দুটি ফ্লাইওভার ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ এবং তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের পুনর্বাসন করা হয়েছে। দশটি রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দশটি ফুটওভারব্রিজ নির্মিত হয়েছে। ৬৪ কিলোমিটার ব্যস্ত সড়কের উন্নয়ন ও ৪৪
কিমি. ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে। মোটরচালিত নয় এমন ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহন চলাচলের নেটওয়ার্কযুক্ত ২২টি সড়কের সংযোগস্থলে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যালিং পদ্ধতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকগুলো বহুমুখী রাস্তার সংযোগ মোড়ের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। রাজউকের অনুমোদিত নকশাসম্মত নয় এমন বহুতল বিশিষ্ট অনেক ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। বহু ভবনের মালিককে নিচতলা সংস্কার করে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা করতে বাধ্য করা হয়েছে। কতিপয় বড় সড়কে ও ভি.আই.পি. এলাকায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেশি যানজট হতো এমন অনেকগুলো রাস্তা একমুখী (ওয়ানওয়ে) করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তার পাশের অবৈধ স্থাপনা ও দোকানপাট অনেকটা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ব্যস্ত ও প্রশস্ত সড়কগুলোর মাঝ বরাবর ডিভাইডার দেওয়া হয়েছে। দিনের বেলায় ট্রাক চলাচল বিশেষ বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। দূরপাল্লার গাড়ি নগরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তাদের জন্য মূল শহরের বাইরে একাধিক টার্মিনাল করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে রিংরোড ও পাতাল রেল নির্মাণের লক্ষ্যে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কিছু বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ট্রাফিক সিগন্যালিংকে আরো আধুনিকায়নের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। কিছু কিছু প্রকল্প অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ ও সময়সাপেক্ষ হলেও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে একদিন এসবের বাস্তবায়ন সম্ভবপর হবে বলে আশা করা যায়।
উপসংহার : রাজধানীর যানজট সমস্যা অত্যন্ত প্রকট একটি সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান খুব সহজ কাজ নয়। সরকারের একার পক্ষে যানজট নিরসন করা প্রায় অসম্ভব। জনগণের সচেতনতা, সুশীল সমাজের আন্তরিকতা ও সরকারের সদিচ্ছার সমন্বয় ঘটলে ঢাকা মহানগরীর যানজটকবলিত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান ঘটানো যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

eighteen − seventeen =