ডিম্বাশয় থেকে অনেক হরমোন ক্ষরিত হয়। তার মধ্যে এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরণ ও অ্যান্ড্রোজেন প্রধান। এসব হরমোনের ক্ষরণের মাত্রা কম-বেশি হলে স্বভাবতই ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে। নিচে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
এস্ট্রোজেন সংক্রান্ত ভারসাম্যহীনতা :
উচ্চমাত্রার এস্ট্রোজেন ঃ ৩৫ বছরের বেশি বয়স্ক নারীর দেহে উচ্চ মাত্রার এস্ট্রোজেন থাকে । এ সংক্রান্ত জটিলতাকে বয়স ও রজঃচক্রজনিত স্বাভাবিক সমস্যা হিসেবে মেনে নিয়ে নারীরা দিন কাটায়। রজঃনিবৃত্ত পর্যায়ের অনেক নারী দেহে এস্ট্রোজেনের অভাব হয়েছে মনে করে, ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা (hormone replacement therapy) করাতে উদ্যোগী হন। প্রকৃতপক্ষে এর ফলে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেন গ্রহণ করে সমস্যা আরও বাড়িয়ে জটিল করে তোলা হয় । যে মহিলারা অতিস্থূল, উচ্চ রক্তচাপবিশিষ্ট বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তারা এস্ট্রোজেনযুক্ত ওষুধ গ্রহণ করে গর্ভাবস্থার কোনো পর্যায়ে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেনজনিত সমস্যায় ভোগে। এ অবস্থার নাম এস্ট্রোজেন ডমিনেন্স (estrogen dominance)। উচ্চমাত্রার এস্ট্রোজেনের ফলে যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায় তার মধ্যে রয়েছে; প্রাক-রজঃচক্রীয় সিন্ড্রোম (pre-menstrual syndrome, PMS)। এর ফলে স্তন ফুলে যায়, স্পর্শকাতর ও ব্যথাকাতর হয়; শরীরে পানি জমে, ওজন বেড়ে যায়; ব্রণ উঠে, স্তনবৃন্ত থেকে স্রাব নির্গত হয়; ভালো ঘুম হয় না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়; দুর্বল লাগে; মাথা ব্যথা, মাইগ্রেন, স্তনব্যথা, পিঠের নিচে ব্যথা হয়; মিষ্টি ও নোনতা খাবারের জন্য ব্যকুল হয়ে পড়ে; আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে; কোনো কাজে মন বসে না; স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে: সহবাসে অনাগ্রহ জন্মে, কিংবা গর্ভপাতও হতে পারে।
নিম্নমাত্রার এস্ট্রোজেন ঃ রজঃনিবৃত্তকালে নিম্নমাত্রার এস্ট্রোজেন থাকা স্বাভাবিক। তবে কারও জরায়ু অপসারিত হলে, কেমোথেরাপি বা বিকিরণ থেরাপির সম্মুখীন হলে বা অটোইম্যুন রোগে আক্রান্ত হলে তাদের শরীরেও এস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যায়। যে সব মহিলার গায়ে চর্বি কম থাকে কিন্তু প্রচন্ড কায়িক পরিশ্রম করতে হয় তাদেরও এস্ট্রোজেন মাত্রা কম থাকে। এস্ট্রোজেন মাত্রা কম হলে বিভিন্ন এনজাইমে স্বাভাবিক কাজ কর্মে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে আহার, চিন্তা, ঘুম, পরিপাক, ব্যথার মাত্রা অনুভবের ক্ষমতা কমে যায়। পরিণতি হচ্ছে অন্য রোগের সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার কবলে পড়া। এস্ট্রোজেন মাত্রা কম হলে যোনিপ্রদেশের চারপাশের প্রাচীর পাতলা হয়ে শুকিয়ে যায় যে কারণে সহবাস কষ্টদায়ক হয়। এর ফলে ইউরেথ্রার প্রাচীরও পাতলা হয়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া, অবসাদ, রাতে ঘাম হওয়া, মনোযোগে বিঘ্ন ঘটা, সন্ধিব্যথা, ত্বক শুষ্ক হওয়া, মাথাব্যথা, মাইগ্রেন, আতংকগ্রস্ত থাকা ইত্যাদিও কম এস্ট্রোজেনের কুফল।
প্রোজেস্টেরণ সংক্রান্ত ভারসাম্যহীনতা :
উচ্চমাত্রার প্রোজেস্টেরণ ঃ প্রোজেস্টেরণ সাধারণত রজঃচক্রকালে ক্ষরিত হয়। যারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করে তাদের দেহে এ হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় । অবসাদ ও যন্ত্রণাহরণকারী ওষুধ সেবনেও প্রোজেস্টেরণের মাত্রা বেড়ে যায়, রজঃস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং ইউরেথ্রার প্রাচীরে প্রভাব বিস্তার করে।
দেহে উচ্চমাত্রার প্রোজেস্টেরণের লক্ষণ হচ্ছে- বুকে ব্যথাপ্রবণতা ও স্ফীত হওয়া, অস্থির মেজাজ, অতিরিক্ত ঘুমভাব, কার্যকর এস্ট্রোজেন স্বল্পতা ইত্যাদি।
নিম্নমাত্রার প্রোজেস্ট্রেরণ ঃ নারীদেহে প্রোজেস্টেরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের একটি। দেহের অনেক সূক্ষ্ণ কাজের উদ্দীপক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এটি অন্যতম মৌলিক হরমোন যা প্রয়োজনে এস্ট্রোজেন ও কর্টিসোন উৎপন্ন করে । নানা কারণে প্রোজেস্টেরণের মাত্রা কমে যেতে পারে । প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- দেহে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেন, ক্রমাগত বা দীর্ঘকালীন চাপ, চিনিযুক্ত খাবার, অপর্যাপ্ত ব্যায়াম এবং কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ সেবন। কোনো নারী নিম্নমাত্রার প্রোজেস্টেরণ সংক্রান্ত সমস্যা ভুগলে কিছু লক্ষণ আগে থেকে প্রকাশ পায়। সে লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণে থাকলে চিকিৎসকের পক্ষে দ্রুত শনাক্ত ও চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অনুর্বরতা, পিত্তথলির অসুখ, অনিয়মিত রজঃচক্র, রজঃচক্রের সময় রক্তজমাট, স্তনব্যথা, শুষ্ক যোনিদেশ, কম ব্লাড-শ্যগার, অবসাদ, ম্যাগনেসিয়াম স্বল্পতা প্রভৃতি।
অ্যান্ড্রোজেন সংক্রান্ত ভারসাম্যহীনতা :
উচ্চমাত্রার অ্যান্ড্রোজেন ঃ নারীদেহে অ্যান্ড্রোজেনের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে প্রয়োজনে এস্ট্রোজেন নামক স্ত্রীহরমোনে পরিবর্তিত হওয়া। এসব হরমোন রজঃনিবৃত্তির আগে, সময়কালীন ও পরবর্তী সময় জননতন্ত্র, অস্থি, বৃক্ক, যকৃত ও পেশিসহ দেহের অন্যান্য অঙ্গ ও সেগুলোর কাজকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। যৌন উত্তেজনা ও মিলনেও অ্যান্ড্রোজেন প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু অ্যান্ড্রোজেনের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে (অতিরিক্ত হলে) উল্লিখিত অঙ্গাদির স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটে। তখন চিকিৎসা না করালে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- ইনসুলিন প্রতিরোধ, ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ প্রভৃতি। দেহে উচ্চমাত্রার অ্যান্ড্রোজেন উপস্থিতির প্রধান লক্ষণ হচ্ছে- অনুর্বরতা, রজঃচক্র অনিয়মিত হওয়া বা একেবারে না হওয়া, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (polycystic ovary syndrome, PCOS), অস্বাভাবিক স্থান লোমশ হওয়া (যেমন- মুখমন্ডল, ঠোঁট প্রভৃতি জায়গায়), চুল কমে যাওয়া, ব্রণ দেখা দেওয়া, ভাল কোলেস্টেরল কমে যাওয়া, খারাপ কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, উদরের চতুর্দিক ঘিরে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি।
নিম্নমাত্রার অ্যান্ড্রোজেন : নিম্নমাত্রার অ্যান্ড্রোজেনে সব বয়সের নারীরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে পারে। তবে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে প্রাকরজঃনিবৃত্ত ও রজঃনিবৃত্তকালীন নারী। এ সময় পিটুইটারী গ্রন্থিতে টিউমার দেখা দিতে পারে এবং হাড়ের ক্ষয় হতে পারে। অবসাদ, উত্তেজনা হ্রাস, ভাল মন্দের বাছবিচার থাকে না, যোনিদেশে শুষ্কতা প্রভৃতি নিম্নমাত্রার অ্যান্ড্রোজেনসংক্রান্ত জটিলতার লক্ষণ।