নারী শিক্ষা অনুচ্ছেদ | নারী শিক্ষার গুরুত্ব রচনা

রচনা

ভূমিকা : দেশ ও জাতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের সহায়ক শক্তি হিসেবে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। পুরুষ ও নারী সমাজদেহে একই সঙ্গে বেড়ে ওঠা দুটি অঙ্গ। সমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে উভয়ের গুরুত্ব সমান। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনের অস্তিত্ব পরিপূর্ণ নয়। সমাজ গঠনে নারী ও পুরুষের ভূমিকা পরস্পর পরিপূরক। কবির ভাষায়—

এ বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।


তাই পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরকেও শিক্ষিত করে তোলা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষাই মানুষকে সুন্দর জীবনের পথ দেখায়। পুরুষদের যেমন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে, তেমনি নারীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও কোনো অংশে কম নয়।
বর্তমানে নারীর অবস্থা : বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে নর-নারীকে কখনোই সমানভাবে দেখা হয়নি। পুরুষ শাসিত এ সমাজব্যবস্থায় পুরুষের সমান শিক্ষার সুযোগ নারীদের নেই। ফলে নারীরা পুরুষসমাজের মতো শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশে শতকরা প্রায় পঁচাশি ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। শহর অঞ্চলে নারী শিক্ষার কিছু সুযোগ থাকলেও গ্রামাঞ্চলে এ সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। তাছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন দিয়েও নারীদেরকে গৃহকোণে

আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। উনিশ শতকে নারীরা ছিল অবরোধবাসিনী। বর্তমানকালেও বাংলাদেশের কোনো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের অবস্থা এতই শোচনীয় যে, তা দেখে উনিশ শতক বা বিশ শতকের গোড়ার দিককার অবরোধবাসিনীদের কথা মনে পড়ে যায়। এ কারণে বাংলাদেশের নারীসমাজ, বিশেষ করে, গ্রামের নারীসমাজ শিক্ষা-দীক্ষায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। বহু গ্রামে এখনো কঠোর পর্দাপ্রথা প্রচলিত আছে। নারীদের এ অনগ্রসরতা এ দেশের জাতীয় অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে। উন্নত দেশে নারীদের অবস্থা অন্য রকম। সেখানে শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেসব দেশের নারীসমাজ আজ পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিক জীবনে নারী শিক্ষা মোটামুটি অগ্রসর হলেও অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে নারীরা এখনো দুর্দশাগ্রস্ত।

নারী শিক্ষা অনুচ্ছেদ

নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে আদৌ কম মূল্যবান নয়। কিন্তু শিক্ষার হারের বিচারে নারীরা পুরুষের চেয়ে পেছনে পড়ে আছে। জাতীয় উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থে নারী জাতির জন্যে অবশ্যই উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সন্তানদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেমেয়েদের ওপর মায়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি থাকে। আচার-আচরণ, সভ্যতা-ভব্যতা ইত্যাদি ছেলেমেয়েরা শেখে মায়েদের কাছ থেকে। সমাজে নারীদের প্রভাব সম্পর্কে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।” আজকের শিশুরা জাতির আগামী দিনের নাগরিক। জাতির এই ভবিষ্যৎ প্রতিপালিত হয় মায়েদের হাতে। মায়েরা যদি উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত না হন, তবে সন্তানের জীবন গঠনে তিনি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। পারিবারিক প্রশাসন ও পরিচালনায় মায়েদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক জীবনের সুখ ও শৃঙ্খলা নারীর ওপরই নির্ভরশীল। শিক্ষিতা নারীই পারে পরিবারে সুখ ও আনন্দের পরিবেশ নিশ্চিত করতে। কিন্তু নারী যদি শিক্ষার আলোকপ্রাপ্তা না হন, তাঁর পক্ষে পরিবার পরিচালনায় সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যবহ। বর্তমান যুগে অফিস-আদালত ও কল-কারখানায় পুরুষদের সঙ্গে নারীদেরও সমানভাবে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে পেছনে ফেলে রেখে জাতির সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। বর্তমান গণতান্ত্রিক যুগে পুরুষের মতো নারীরাও পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করছে। প্রাচীনকালের নারীদের মতো আজকের নারী আর দাসী নয়। উন্নত দেশে নারীরাও পুরুষদের পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। সেসব দেশে নারীরা পূর্ণরূপে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। তেমনি এ দেশের নারীদেরও উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া আবশ্যক। জাতি গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষিত নারীসমাজ পুরুষের পাশাপাশি সমান শক্তি ও দক্ষতা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে।

নারী শিক্ষার অন্তরায় ও সমাধানের উপায় : ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রধান অন্তরায়। পর্দাপ্রথার কঠোরতার কারণে দেশের অনগ্রসর পল্লি অঞ্চলে, বিশেষ করে, মুসলিম পরিবারে নারীরা আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না। নিরাপত্তার অভাব নারী শিক্ষার পথে অন্যতম অন্তরায়। অভিভাবকেরা নিরাপত্তার অভাবের কারণে তাঁদের কন্যা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে স্বস্তি পান না ও নিশ্চিন্ত-বোধ করেন না। নারী শিক্ষার আর একটি অন্তরায় হলো দারিদ্র্য। অধিকাংশ অভিভাবক দরিদ্র; দারিদ্র্যের কারণেও তাঁরা মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাতে পারেন না। সর্বোপরি, দেশে নারী শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব আছে। পর্যাপ্তসংখ্যক স্কুল নেই; স্কুল যা আছে তা-ও অনেক দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত থাকার কারণে মেয়েদেরকে পাঠানো অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের বিপুলসংখ্যক নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ দিতে হলে বিশাল আকারে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদেরকে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সকল পর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করে নারী শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখতে হবে। নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্যে কতকগুলো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। গোঁড়া ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অভিভাবকদেরকে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝাতে হবে। বাংলাদেশ বহু ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা ইত্যাদি অভিশাপ থেকে এ দেশকে মুক্ত করতে হলে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরকেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে। এজন্যে নারীসমাজকে অবশ্যই উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। অশিক্ষিত নারী সন্তানের জীবন গঠন, পারিবারিক পরিবেশ উন্নয়ন, সামাজিক উৎকর্ষসাধন কিংবা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এসবের কোনো ক্ষেত্রেই যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না। কাজেই, দেশ ও জাতির অগ্রগতি সাধনের ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার কোনো বিকল্প নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে মেয়েদের জন্যে স্কুল পর্যায়ে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। এ ব্যবস্থা সম্প্রতি কলেজ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন এন.জি.ও. নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বহু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
উপসংহার : নারী শিক্ষা সম্পর্কে অতীতের তুলনায় আজকাল জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে স্কুল-কলেজে ছাত্র সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। নাগরিক জীবনে নারীসমাজ গোঁড়ামি থেকে বহুলাংশে মুক্তি লাভ করেছে। গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকেরাও নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্যে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। সমগ্র নারীসমাজ উপযুক্তরূপে শিক্ষা গ্রহণ করে পুরুষদের সঙ্গে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করলে বাংলাদেশ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

20 + nineteen =