ভূমিকা : রমজানের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন আশ্বিন মাস। তখনো রোজা শুরু হয়নি। ছেলেবেলার
বন্ধুদেরকে কাছে পেলাম। তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম নৌকা ভ্রমণে যাব। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বাঁকখালী নদী। নদী দিয়ে নৌকায় আট কিলোমিটার গেলে বড় আপার শ্বশুরবাড়ি। স্থির হলো আমরা নৌকা করে আপার বাড়ি বেড়াতে যাব। আমাদের পরিকল্পনার কথা মাকে বললাম। মা বাবাকে বললেন। উভয়ের অনুমতি পাওয়া গেল।
যাত্রা : যাবার দিনক্ষণ ঠিক করলাম। নৌকা ভাড়া করা হলো। মাঝির সঙ্গে আলাপ করে নিলাম। নির্দিষ্ট দিনে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে তিন বন্ধু নৌকায় উঠলাম। সঙ্গে কিছু কলা, মুড়ি ও বিভিট নিলাম। বড় একটি ফ্লাঙ্কে চা বানিয়ে নিলাম। বিকেলে খাওয়া যাবে। সঙ্গে আরো নিলাম একটি রেডিও, টেপরেকর্ডার ও ক্যামেরা। তিনজনের প্রত্যেকের কাছে মোবাইল ফোনও ছিল।

ভ্রমণের বর্ণনা : আমাদের সব প্রস্তুতি শেষ হলে মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। নদীর দু’তীরের গ্রামগুলো বড়ই সুন্দর। নৌকায় দুই বাঁধা ছিল। আমরা ছইয়ের ওপর বসলাম। স্রোতের অনুকূলে নৌকা হেলে-দুলে এগিয়ে চলল। নদীর দুই তীরে ছিল খোলা মাঠ মাঠে ছিল সবুজ ধান। বাতাসের দোলায় ধানের ক্ষেত তালে তালে দুলছে। কবির কথা মনে পড়ল ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায়। দামাল ছেলের মত। দুতীরের গ্রামগুলো পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে আমাদের নৌকা। মাঝে মাঝে দেখতে পেলাম ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা তীরের কাছে পানিতে খেলা করছে। কেউ কেউ ডুব সাঁতার কাটছে। একে অন্যের গায়ে পানি ছিটিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে আবার কেউ কেউ হৈচৈ করে নদীর ঘাট তোলপাড় করছে। কোথাও কোথাও দেখা গেছে পল্লীবধূরা কলসি কাঁখে নদী থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ছইয়ের ওপর বসে ক্যাসেট বাজিয়ে গান শুনছিলাম। নিম্নদ্ধ বিকেলে গানের আওয়াজ নদীর তীরেও শোনা যাচ্ছিল। গ্রামের বধূরা মুখ হয়ে আমাদের গান শুনছিল। আর বিস্ময়ভরা চোখে আমাদের নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে গেল, আমাদের পেটে খিদে লেগে গেল। সবাই মিলে নাস্তা করলাম, মাঝিকেও দিলাম। আমাদের সঙ্গে মিনারেল পানির বোতল ছিল। তা থেকে পানি খেলাম; ফ্লাঙ্ক থেকে চা খেলাম।
ঝড়ের কবলে: চা-নাস্তা সেরে আকাশের দিকে তাকাতেই দেখলাম, হঠাৎ আকাশ যেন কালো মেঘে ভরে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে মেঘের ছায়া পড়তে শুরু করেছে- ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। ধীরে ধীরে বাতাসের গতি বেড়ে চলেছে। হঠাৎ দমকা হাওয়া শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করল। প্রবল বেগে ঝড় আরম্ভ হলো। আমাদের নৌকা উল্টে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমাদের মাঝি ছিল অত্যন্ত অভিজ্ঞ। মাঝি অতি দ্রুত নৌকাটি কূলে ভিড়িয়ে নিল- একটি নিরাপদ স্থানে নোঙর করে অপেক্ষা করতে লাগল। আমরা ততক্ষণে ছইয়ের ওপর থেকে নেমে ভেতরে আশ্রয় নিয়েছি। ভয়ে জড়সড় হয়ে আমরা নৌকার মধ্যে বসে কাঁপতে লাগলাম। মাঝি আমাদের অভয় দিল। বল, বাতাসের এই ঝাপটা আধ ঘণ্টার মধ্যে থেমে যেতে পারে। মাঝির কথাই সত্য হলো। আস্তে আস্তে ঝড় থেমে গেল। রুদ্র প্রকৃতি শান্ত হয়ে এলো। আকাশ ক্রমে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। মাঝি নতুন উৎসাহে আবার নৌকা ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আকাশে চাঁদ উদিত হলো, তারার মেলা বসল। রুপালি চাঁদের আলোতে নদীর ঢেউগুলো চিকচিক করে উঠল। এমন সময় মনের আনন্দে মাঝি গেয়ে উঠল। মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না। মাঝির গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্ধু শাহীন বাঁশিতে সুর তুলল। সেই শিখ সন্ধ্যায় নদীর বুকে মাঝির ভাটিয়ালি গান আর বন্ধুর বাঁশির সুর আমরা প্রাণভরে উপভোগ করলাম।
উপসংহার: রাত প্রায় আটটার দিকে আমরা অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। মাঝি ঘাটে নৌকা ভিড়াল। আমরা তীরে উঠে। আমার আপার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ভ্রমণের আনন্দ ও ঝড়ের ভয় মিলে যে অপূর্ব অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করেছি তার তুলনা হয় না। সেদিনের নৌকা ভ্রমণে আমরা একই সঙ্গে প্রকৃতির সুন্দর ও ভয়ঙ্কর রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। এ মধুর স্মৃতি আমার অনেক দিন মনে থাকবে।