পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা

রচনা

ভূমিকা : পরিবেশ বলতে সাধারণত পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেই বোঝায়। মানুষের বসবাসের উপযোগী এলাকাকে বলে তার পরিবেশ। আমাদের চারদিকে রয়েছে গাছপালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মাঠ-ঘাট, জীবজন্তু, পশু-পাখি। এগুলো আমাদের জীবনধারণে সহায়ক উপাদান। এসবগুলো মিলে চারপাশের যে প্রকৃতিকে অবস্থা, তার নামই পরিবেশ। পরিবেশের আনুকূল্যে মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন পরস্পরের নির্ভরশীলতায় বিকাশ লাভ করে। আবার পরিবেশের প্রতিকূলতায় সবারই জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। এরা নিজ নিজ পরিবেশ থেকে বেঁচে থাকার সামগ্রী গ্রহণ করে। সেসব সামগ্রী থেকে প্রয়োজনীয় অংশ ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত অংশ পুনরায় সে পরিবেশে ফিরে যায়। এভাবে জীবজগৎ ও পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকার সামগ্রীর গ্রহণ-বর্জন চলে। এই গ্রহণ-বর্জনের ভারসাম্য নষ্ট হলে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। পরিবেশের যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তনই পরিবেশ দূষণ।

পরিবেশ দূষণের শুরু : পরিবেশ দূষণ নতুন কিছু নয়, বহু প্রাচীনকাল থেকে মানুষ দ্বারা পরিবেশ দূষিত হয়ে আসছে। মানবসভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে সারা পৃথিবীতে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, পারমাণবিক পরীক্ষা, বিস্ফোরণ ইত্যাদির ফলে আকাশ-বাতাস, সাগর-মহাসাগর দূষণের কবলে পড়েছে।

পরিবেশ কীভাবে দূষিত হয় : মানুষ যেসব জিনিস ব্যবহার করে তার পরিত্যক্ত বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ থেকেই পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি হয়। পরিবেশ দূষণ প্রধানত তিন ধরনের হয়ে থাকে—
১. বায়ুদূষণ, ২. পানি, ৩. শব্দদূষণ।

বায়ুদূষণ : বাতাসের ভেতর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। এসব
জীবনধারণের উপযোগী উপাদান হ্রাস পেয়ে, বাতাসে ক্ষতিকর উপাদান বেড়ে গেলে তাকে বায়ুদূষণ বলে যানবাহন, চুল্লি, কলকারখানার চিমনি ইত্যাদি থেকে নির্গত ধোঁয়ার দ্বারা বায়ু দূষিত হয়। ধুলো, বালি, কীটনাশক, রাসায়নিক বর্জ্য, গ্যাস ইত্যাদি বাতাসকে প্রতিনিয়ত দূষিত করে চলেছে। তাছাড়া জীবজন্তুর গলিত দেহ, পচা বর্জ্য আবর্জনার মতো অন্যান্য উপাদানের দ্বারাও বাতাস দূষিত হয়। বায়ুদূষণের ফলে হৃদরোগ, ফুসফুসের প্রদাহ, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, টি.বি., অঙ্গবিকৃতিসহ অনেক রকম রোগব্যাধি হতে পারে।

পানিদূষণ : সারা পৃথিবীতে শিল্প নগরীগুলো গড়ে উঠেছে নদী বা সমুদ্রকে কেন্দ্র করে। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পৌর ও শিল্পবর্জ্য নদী, হ্রদ ও সাগরে ফেলা হয়। এসব বর্জ্যের অতি উঁচু মাত্রার বিষপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান দ্বারা নদী, হ্রদ, সাগরের পানি দূষিত হয় এবং এর ফলে জলজ প্রাণী মারা যায়। এছাড়া কৃষিতে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কীটনাশক পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করছে। তেলবাহী জাহাজ থেকে তেল নিঃসৃত হয়েও সমুদ্রের পানি দূষিত হতে পারে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের উন্মুক্ত ও দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণেও পানি দূষিত হয়। পানি দূষণের ফলে নানা রোগ ছড়াতে পারে।

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা

শব্দদূষণ : পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে শব্দদূষণের ভূমিকাও কম মারাত্মক নয়। রাস্তাঘাটে উৎকট হাইড্রোলিক হর্নের শব্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইরেন, মিছিল-শোভাযাত্রার অস্বাভাবিক কোলাহল, বোমা-পটকার আওয়াজ, মাইকের শব্দ ইত্যাদি আমাদের পরিবেশকে দূষিত করে। শব্দদূষণের ফলে নিদ্রাহীনতা, শিরঃপীড়া, বধিরতা, স্নায়বিক দুর্বলতা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার মতো রোগ দেখা দিতে পারে। এজন্য হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে মাইক ও হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পরিবেশ দূষণের পরিণতি : পৃথিবীর অধিবাসীরাই নিজেদের তৈরি কার্যকলাপের দ্বারা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। এতে এই গ্রহে প্রাণিজগতের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে। ব্যাপক হারে বৃক্ষ নিধন, বনাঞ্চল উজাড় করা ইত্যাদি নানা কারণে দেখা দিয়েছে ‘গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া’। বিশ্ব পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট হচ্ছে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া। বিভিন্ন কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেইন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস বেড়ে যাবার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে, বরফ গলার পরিমাণ বেড়ে যাবে, ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে এবং ক্রমান্বয়ে বহু শহর-নগর, দ্বীপ, নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাবে। তাছাড়া খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঝড়, ঘূর্ণিবাত্যা ইত্যাদি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে ইতোমধ্যে পৃথিবী থেকে ৭৬ রকমের প্রাণী ও কয়েক হাজার গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ১৩২ রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৬ রকমের প্রজাতির পাখির বংশ বিলুপ্তির পথে। বহু সমতলভূমি মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। যানবাহন ও কলকারখানা থেকে প্রতিবছর ২০ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ১৫ কোটি টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ৫ কোটি টন হাইড্রো কার্বন ও অন্যান্য গ্যাস নির্গত হয়ে বাতাসে জমা হচ্ছে।

প্রতিকারের উপায় : পৃথিবীতে অধিকাংশ পরিবেশ দূষণ ঘটছে মানুষের কারণে; এই দূষণের ব্যবস্থা তাই মানুষকেই করতে হবে। পরিবেশ দূষণের প্রতিকারের সম্ভাব্য উপায়গুলো নিচে সংক্ষেপে আলোচিত হলো-

১. যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করে : বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সময় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে তা অধিক শব্দ উৎপাদক না হয় এবং কালো ধোঁয়া বের না হয়। কীট নিধান জৈব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। শিল্পাঞ্চল ও কল কারখানাগুলো লোকালয় থেকে অনেক দূরে স্থাপন করতে হবে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটরযানে হাইড্রোলিক হর্নের পরিবর্তে সাধারণ হর্ন ব্যবহার করতে হবে। পানি দূষণ দূর করার জন্য রাসায়নিক পদার্থ ও ময়লার বিশোধন দরকার।

২. বনায়নের মাধ্যমে : বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে নগরে ও গ্রামে অধিকসংখ্যক গাছ লাগিয়ে পরিবেশ দূষণ রোধ করা যেতে পারে। সর্বাধিক বৃক্ষ রোপণকারীকে উৎসাহমূলক পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

৩. আইন প্রণয়নের মাধ্যমে : আইন প্রণয়ন করে কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা করে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। আইন প্রণয়ন করে বিনা কারণে বৃক্ষ নিধন রোধ করা যেতে পারে।

৪. গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে : জীবনধারণের প্রয়োজনে মানুষ যা করে এবং খাদ্য হিসাবে যা গ্রহণ করে সেসব জানার জন্য বাল্যকাল থেকে শিশু-কিশোরদের জ্ঞান দিতে হবে, কারণ আমাদের খাদ্যচক্রের মাধ্যমেও পরিবেশ দূষণ ঘটে থাকে। এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন; নতুবা ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা আছে।

উপসংহার: পরিবেশ দূষণ মানবজাতির জন্য এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের মানুষকে সচেতন করা দরকার। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সমস্যাটি অধিক প্রকট। জাতীয় স্বার্থে এ ভয়াবহ সমস্যা সমাধানের জন্য তৎপর হতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য একটি সুন্দর ও বিপদমুক্ত পৃথিবী নিশ্চিত করা

আমাদের একান্ত কর্তব্য।



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

eleven − 8 =