প্রাণী আচরণ গবেষণায় তিন-কাঁটা স্টিকলব্যাক

জীববিজ্ঞান
মাছের অপত্য যত্নপ্রাণী আচরণ গবেষণার তিন-কাঁটা স্টিকলব্যাক মাছের গুরুত্ব অনেক। এ মাছের বিস্তৃতি দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর (Black Sca), দক্ষিণ ইতালি, আইবেরিয়ান পেনিনস্যুলা, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়ায় জাপানের উত্তর অংশে, উত্তর আমেরিকা এবং গ্রীনল্যান্ডে। আচরণবিদ্যার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ মাছের আচরণের উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে। প্রখ্যাত আচরণবিজ্ঞানী টিনবারগেন (Tinbergen) তিন- কাঁটা স্টিকলব্যাকের উপর গবেষণা করেছেন।এক থেকে তিন বছর বয়সে তিন-কাঁটা স্টিকলব্যাক পরিণত (mature) হয়। জননকাল ছাড়া অন্য সময়ে ঝাঁকবদ্ধ হয়ে বাস করে। বসন্তকালে অর্থাৎ জননকালে পরিণত স্টিকলব্যাকেরা দলহীন হয়ে উপকূলবর্তী অগভীর পানির জলাশয়ে নিজস্ব বিচরণ পরিসীমা নির্ধারণ করে সতর্ক পাহাড়ায় নিযুক্ত থাকে। কারও অনুপ্রবেশে হানাহানি না করে বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও বর্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। বিচরণ পরিসীমা প্রতিষ্ঠার পর সেখানে বাসা নির্মাণ শুরু করে। বাসা নির্মাণে শুধু পুরুষ সদস্যই কাজ করে। বাসা নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গার তলদেশ থেকে মুখভর্তি বালু তুলে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার দূরে নিক্ষেপ করে। এভাবে একটি অগভীর গর্তের সৃষ্টি হলে পুরুষ মাছ সূত্রাকার শৈবাল ও অন্য জলজ উদ্ভিদ, নুড়ি ও অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ জড়ো করে বৃক্ক থেকে ক্ষরিত এক ধরনের প্রোটিনজাত আঠালো পদার্থে আটকে দেয়। সকল তিন-কাঁটা স্টিকলব্যাকের বাসার নির্মাণশৈলী এক হয় না, স্বতন্ত্র রুচির বিষয় মাছের বেলায়ও প্রযোজ্য। কোন কাঠামো কোন স্ত্রী মাছের পছন্দ হবে তারও ব্যাপার আছে। যা হোক, বাসাটি দুমুখ খোলা, মধ্যভাগ ফাঁকা ও সামান্য চওড়া ধরনের।বাসা নির্মাণ শেষ হলে পুরুষ মাছ উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় স্ত্রীমাছকে আকৃষ্ট করে বাসায় ঢুকিয়ে লেজটাকে ধাক্কা দিয়ে ডিম পাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ডিম পাড়া শেষ হলে পুরুষ মাছ অতিদ্রুত বাসায় প্রবেশ করে ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে। একটি বাসায় দু-তিনটি স্ত্রীমাছ ডিম পাড়তে পারে। এরপর পুরুষ মাছটি পিতা ও মাতা উভয়ের ভূমিকা পালন করে ডিমের দেখা শোনা আরম্ভ করে।নীড় ও নীড়ের ভেতর থাকা নিষিক্ত ডিমগুলো থেকে সুস্থ পোনা উৎপাদন, রক্ষা, যত্ন নেওয়া ও সবশেষে নিরাপদে পরিবেশে ফিরে যাওয়া অনুকূলে রাখতে পুরুষ মাছ সদাব্যস্ত থাকে। এ সময় বাসার কাছে নিজ প্রজাতির সদস্যসহ কোনো মাছ বা ক্ষতিকর প্রাণীর প্রবেশ রোধ করতে মাছ সদা তৎপর থাকে। ডিম ফোটার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য স্টিকলব্যাক এক অদ্ভূত আচরণ করে। বাসায় প্রবেশ পথের সামনে মাথা নিচু করে তীর্যকভাবে অবস্থান নিয়ে বক্ষপাখনা সামনের দিকে সঞ্চালিত করে। এভাবে অক্সিজেন চাহিদা নিশ্চিত করতে পানিস্রোত অব্যাহত রাখে। এ প্রক্রিয়ার নাম ফ্যানিং (fanning)।সাত-আটদিনের মধ্যে ডিম ফুটে পোনা বেরিয়ে বাসা ত্যাগ করতে শুরু করলে ফ্যানিং বন্ধ করে দেয়। পোনাগুলো পাহারা দেওয়ার সময় স্টিকলব্যাক আক্রমণাত্তক হয়ে উঠে। পোনার দল অটুট রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো কারণে দলের কিছু পোনা দলছুট হলে পুরুষ মাছটি দ্রুত সেগুলোকে মুখে তুলে এনে মূলদলে ছেড়ে দেয়। দুসপ্তাহ পর পোনা দলবদ্ধ চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে অতিযত্ন ও সতর্কতার মধ্যে রেখে বড় করে তোলা ভবিষ্যৎ বংশধরগুলোকে নিজের পূর্ণবয়স্ক ঝাঁকে ফিরে যায়।ব্যাঙের অপত্য যত্নভবিষ্যৎ বংশধরের পরিস্ফুটন যেন নির্বিঘ্ন হয় সে উদ্দেশে সতর্ক-সযত্নে বাসা নির্মাণ করে ডিম পাড়া কিংবা সদ্য পরিস্ফুটিত বংশধর বেড়ে না উঠা পর্যন্ত পিতা-মাতার যে কোনো একজন বা উভয়কেই সঙ্গে থাকাকে অপত্য যত্ন বলে । অপত্য যত্ন অন্যতম সহজাত প্রবৃত্তি যা প্রায় সব প্রাণিগোষ্ঠীতেই কম-বেশি দেখা যায়। উভচরেও বিচিত্র অপত্য যত্নের পরিচয় পাওয়া যায়, বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় উভচরে এমন যত্নের উদাহরণ বেশি। উভচরের অপত্য যত্নকে প্রধান দুটি শিরোনামের অধীনে বর্ণনা করা হয়ঃ (ক) বাসা, আঁতুরঘর বা আশ্রয় নির্মাণের মাধ্যমে যত্ন এবং (খ) ডিম বা লার্ভা পরিবহনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ যত্ন।নিচে গ্লেডিয়েটর ব্যাঙ নামে পরিচিত দক্ষিণ আমেরিকার Hypsiboas rosenbergi) গেছো ব্যাঙের অপত্য যত্নের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো।কাদা-মাটির নীড় (mud-nest) নির্মাণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার উদ্দেশে বসতির আশেপাশে পুকুর, ডোবা বা এ ধরনের স্থায়ী জলার পাড়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। জননকালে পুরুষ ব্যাঙ এমন এক জায়গা বেছে নেয় যাতে গর্তখোঁড়া সহজ হয়, নির্মাণ কাজ রাতারাতি সম্পন্ন হয়। বাসা নির্মাণ, সে বাসা স্ত্রী ব্যাঙের পছন্দ হওয়া এবং নিরাপত্তা বিধান সবকিছু মাথায় রেখে স্ত্রী ব্যাঙ ডিম পাড়ে। অতএব বাসা নির্মাণকে প্রাধান্য দিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় পুরুষ ব্যাঙকে। এ ক্ষেত্রে পুরুষ ব্যাঙ তিন উপায়ে বাসা নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রথমত সে নিজেই বাসা বানায়; দ্বিতীয়ত পানি ভর্তি অগভীর গর্তকে সামান্য মেরামত করে বাসায় পরিণত করে; এবং তৃতীয়ত অন্য এক পুরুষ ব্যাঙের নির্মিত বাসা দখল করে নেয়। এখানে আলোচ্য গ্লেডিয়েটর পুরুষ ব্যাঙ সাধারণত বেলে বা কাদামাটিতে আগে থেকে কোনো কারণে সৃষ্টি হওয়া গর্তকে দ্রুত বাসা বানিয়ে ফেলে। আগের জনন ঋতুতে ব্যবহৃত বাসাকে ডিম পাড়ার উপযোগী করেও কাজে লাগাতে পারে। গবাদি পশু হেঁটে গেলে জলার কিনারে যে গর্ত হয় সেটাকেও একটু বড়সড় ও মসৃণ করে ডিম পাড়ার উপযোগী করে নিতে পারে।পুরুষ ব্যাঙ গর্ত খুঁড়তে গিয়ে এমনভাবে মাটি সরায় যাতে মাটি স্তুপাকারে পড়ে গেলে উঁচু কিনারার রূপ নেয়। গর্তের ব্যাস প্রায় ১২-৩৭২ সেন্টিমিটার, আর ৫-৭ সেন্টিমিটার গভীর। তিরিশ মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে বাসা নির্মাণ সমাপ্ত হয় । বাসা নির্মাণ সম্পন্ন হলে পুরুষ ব্যাঙের ডাকে স্ত্রী ব্যাঙ সাড়া দিলেও বাসা ঘুরে-ফিরে দেখে পছন্দ হলে তবেই ডিম ছাড়তে উদ্যত হয়। ডিম ফুটে লার্ভা নির্গত হলে ওদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, নিরাপত্তা বজায় থাকে সবদিক বিবেচনা করে স্ত্রী ব্যাঙ সিদ্ধান্ত নেয়। ডিম ছাড়ার পর এলাকাভেদে পুরুষ ব্যাঙ তার বংশ রক্ষায় তৎপর থাকে। যেখানে বাসা তৈরির জায়গা কম কিন্তু পুরুষ ব্যাঙের সংখ্যা বেশি থাকে সে সব জায়গায় আগ্রাসী বা সন্ত্রাসী পুরুষ ব্যাঙ অন্য ব্যাঙের বাসা দখল করে স্ত্রী ব্যাঙকে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে। অবস্থা বুঝে পুরুষ ব্যাঙ শক্ত হাতে বাসা রক্ষা করে। লার্ভা তরুণ ব্যাঙে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত গর্তের পাশে থেকে পাহাড়া দেয়।গ্লেডিয়েটর ব্যাঙে মার্চ-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জননকাল হিসেবে পরিচিত। স্ত্রী ব্যাঙ উপযুক্ত বাসায় ১০ মিনিটের মধ্যে প্রায় তিন হাজার ডিম ছাড়ে। দুই তিন দিনের মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা নির্গত হয় । চল্লিশ দিনের মধ্যে এদের রূপান্তর ঘটে।


About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

18 + 18 =