বাংলাদেশের নদ নদী ও তার ইতিহাস

ইতিহাস

বাংলাদেশের নদ নদীর বর্ণনা

ছোট-বড় মিলিয়ে বাংলাদেশে নদ নদীর সংখ্যা 230 টি. এ নদীগুলোর অধিকাংশই ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা কিংবা তিস্তার শাখা কিংবা উপনদী. বড় নদী গুলোর গতিপথ অসংখ্য বার পরিবর্তিত হয়েছে ফলে অনেক নদী যেমন আজ মৃত তেমনি আবার সৃষ্টি হয়েছে নতুন জলধারার. বাংলাদেশের নদীগুলোর উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে.

বাংলাদেশের নদ নদীর উৎপত্তিস্থল

পদ্মা – হিমালয়ের গঙ্গৌত্রি হিমবাহ; যমুনা- তিব্বতের মানস সরোবার; ব্রহ্মপুত্র- তিব্বতের মানস সরোবর; কর্ণফুলী- মিজোরামের লুসাই পাহাড়;

নদনদী

বাংলাদেশের নদ নদীর নাম ও তার বর্ণনা

ব্রহ্মপুত্র: এটি তিব্বতের মালভূমি তে অবস্থিত মানস সরোবর এর নিকটবর্তী চেমাইয়াডুং হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বতে সেংগু নামধারণ করে আসামের মধ্য দিয়ে বৃহত্তম রংপুরের (নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলা) মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে.এর আন্তর্জাতিক দৈর্ঘ্য 1800 মাইল বর্তমানে এটি যমুনার খাত দিয়ে একশত পঞ্চাশ মাইল প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দের নিকট পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে .এর মিলিত ধারা পদ্মা নাম নিয়ে চাঁদপুরের নিকট মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে  “ত্রিধারা মেঘনা” নামধারণ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে.মহাভারতে ব্রহ্মপুত্রকে “লৌহিত্য”  নাম উল্লেখ করা হয়েছে পুরাণের এর নাম উল্লেখিত হয়েছে “ব্রহ্মপুত্র”. টলেমি  এ নদীর নাম বলেছেন আন্তিবল  বা আহ্রাদন ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ উল্লেখ করেছেন যে, ত্রয়োদশ শতকে ব্রহ্মপুত্র আয়তন গঙ্গার তিনগুণ ছিল. অষ্টাদশ শতকের বেশিরভাগ যমুনার উৎপত্তির পর থেকে এ নদীর ধারাটি  ক্ষিণ  হতে থাকে. 1866 সালে ময়মনসিংহের কালেক্টর রেনল্ডস( Renolds ) বলেছিলেন যে,  দশ বছর পূর্বে তিনি এ নদীটিকে যে রূপে দেখেছিলেন বর্তমানে তা শীর্ণ হয়ে গেছে. তিনি মন্তব্য করেছেন যে এক সময় একটি অদৃশ্য সূত্রে পরিণত হবে. তার ভবিষ্যৎ বাণী আজ সত্যে পরিণত হয়েছে.

ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি গতিপথ পরিবর্তিন করেছে. ষোড়শ শতকে এটি মধুপুর জঙ্গলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঢাকা জেলার পূর্বঞ্চল হয়ে সোনারগাঁও লাঙ্গলবন্দের নিকট দিয়ে বর্তমান ধলেশ্বরী নামে পরিচিত গঙ্গার সাথে মিলিত হতো. উত্তরবঙ্গে “করোতোয়া” একসময় ব্রম্মপুত্রের মূল প্রবাহ ছিল.

যমুনা: রেনেল 1780 সালে  বঙ্গদেশের যে  মানচিত্র এঁকেছিলেন তাতে ” যমুনা” নদীর কোন উল্লেখ ছিলনা. এর 30 বছর পর বুকানন হামিল্টন ব্রম্মপুত্রের প্রধান শাখা হিসেবে “যমুনার (যবুনা)” উল্লেখ করেন.1787 সালে বাংলায় যে প্রবল বন্যা হয় তাতে এ দেশের ব্যাপক ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটেছিল. এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম হান্টার বলেন.’ The streets of Dhaka city were submerged to a depth sufficient to admit boats sailing them. 60,000 persons perished during the inundation and subsequent famine.’ এ মহাপ্লাবনের ফলে ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে তিস্তার সাথে মিলিত হয়.অষ্টাদশ শতকের পূর্বে যিনাই নামে এক ক্ষুদ্র খাল হিসেবে যমুনা প্রবাহিত হতো. 1887 সালে সালের সমসাময়িক একটি প্রবল ভূ-আন্দোলনে বরেন্দ্রভূমি মধুপুর গড় অঞ্চল থেকে পৃথক হয়ে পড়ে. এর ফলে তিস্তা, আড়াই, মহানন্দা,  পূর্নভবা প্রভৃতি নদীর পানি শীর্ণ  যিনাই এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বৃহৎ যমুনা প্রবাহের  সৃষ্টি হয়. বর্ষাকালে কোন কোন স্থানে যমুনা  4/5 মাইল প্রশস্ত হয়.

পদ্মা: হিমালয় পর্বতমালার 12800 ফুট উচুঁতে ” গঙ্গোত্রী” হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তর প্রদেশ বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা নদী- ভাগীরথী ও পদ্মা নামে বিভক্ত হয়েছে. রাজশাহী জেলার ভিতর দিয়ে পদ্মা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে. গোয়ালন্দের নিকট এটি যমুনার সাথে মিলিত হয়. এ মিলিত স্রোতধারা চাঁদপুরের নিকট মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে. ডি. বারোজের মানচিত্রে পদ্মাকে অনেক বড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে.পদ্মা অতীতে অনেক বার তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে চতুর্দশ শতকে পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় তার পঞ্চদশ শতকে পরিব্রাজক মা হুযান এর বিবরণ থেকে জানা যায়, সেসময় পদ্মা চট্টগ্রামের নিকট দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতো. আইন-ই-আকবরি প্রণেতা আবুল ফজল একই কথা উল্লেখ করেছেন. রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী পদ্মার প্রাচীন প্রবাহ ফরিদপুর জেলার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বরিশাল জেলার  মেহেন্দিগঞ্জর   নিকট “কন্দর্পপুরে “মেঘনার সাথে মিলিত হতো. পরে এ ধারাটি, যা ময়নাকাটা ও আড়িয়াল খাঁ নামে পরিচিত ছিল.পদ্মার বর্তমান প্রবাহ একসময় পশ্চিমদিকে প্রবাহিত প্রাচীন হয়ে কালিগঙ্গা ধরে বিক্রমপুরের ভিতরদিয়ে অগ্রসর হয়েছে .এ ধারাটি “কীর্তিনাশা” বা “নয়াভাঙ্গনী” নামে পরিচিত. রেলের মানচিত্রে এ ধারাটির উল্লেখ ছিলনা. তবে 1840 সালে ” ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকা” গ্রন্থ টেলর “কীর্তিনাশার” উল্লেখ করেছেন.রেনেল অবশ্য পদ্মার আরেকটি ধারার কথা অনুমান করেছিলেন যা বর্তমান প্রবাহের উত্তর দিক দিয়ে মুন্সিগঞ্জের নিকট মেঘনার সাথে মিলিত হতো. বর্তমানে পদ্মার আরও দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন. সুতরাং দেখা যাচ্ছে অতি সাম্প্রতিক কালের মধ্যে পদ্মা তিনবার এর গতিপথ পরিবর্তন করেছে.

মেঘনা: মেঘনা নদের উৎপত্তি ভারতের কাছার জেলা ও বাংলাদেশের সিলেট জেলার বহু পাহাড়ি স্রোতের মিলিত ধারা থেকে.আসামের পর্বত দিক “বারাক” -সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে সিলেটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুনরায় ‘”কালনী” নিয়ে একত্রিত হয়েছে. এটি বর্তমানে ভৈরব বাজারের নিকট ব্রহ্মপুত্র সাথে এবং চাঁদপুরে পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে. মেগাস্থিনিসের ” ইন্ডিকা” এটিকে  “মোগান” বলে উল্লেখ করা হয়েছে অষ্টাদশ শতকের এর পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ একে Cosin  নামে চিহ্নিত করেন. রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী, পদ্মার প্রাচীন ধারা মেঘনার সাথে মেহেন্দিগঞ্জের নিকট মিলিত হতো. বর্তমানে গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রসহ আরো কতিপয় নদীর জলরাশি এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে এর নিম্নভূমি (নোয়াখালী, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর) প্রবাল ভাঙ্গনের মুখোমুখি হচ্ছে.ভারতের আসাম, ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল, সিলেট কুমিল্লা ও নোয়াখালী মেঘনার অববাহিকা অঞ্চল.

তিস্তা: তিস্তা খুব বড় নদী নয়. তবে এর গতিপথ বাংলাদেশের অনেক ভৌগলিক পরিবর্তন সাধন করেছে. প্রাচীন ত্রি-শ্রোতা থেকে তিস্তা নামটির উৎপত্তি. ভনডেন ব্রোকের মানচিত্র অনুযায়ী, তিস্তা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে. পূর্বের ধারাটি করোতয়া,মাঝের ধারাটি আড়াই এবং পশ্চিমের ধারাটি পূনর্ভবা. রেনেলের মানচিত্রেও তিনটি ধারার উল্লেখ আছে. খ্রিষ্টিয়  প্রথম লিখিত পেরিপ্লাস গ্রন্থও তিস্তা(psitars) নদীর উল্লেখ দেখা যায়. 1786 সালের বন্যার সময় তিস্তা পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্রহ্মপুত্র সাথে মিলিত হয়.

বাংলাদেশের নদ নদী অনুচ্ছেদ 

অথবা

বাংলার জনজীবনে নদ নদীর প্রভাব

বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জনজীবনে নদ নদীর ভাঙা-গড়ার খেলা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে. নদীর গতিপথ পরিবর্তন একদিকে ভৌগলিক চেহারা বদলে দিয়েছে বারবার, অপরদিকে নদী উপত্যকার লোকদের মানস গঠনও ফেলেছে গভীর প্রভাব.এ সম্পর্কে উইলিয়াম হান্টার বলেন. ‘The vast province of lower bengal is in the strictest scientific sense the gift of the Ganges, the Brahamaputra and the Meghna.’বাংলার সভ্যতা নদী তীরবর্তী সভ্যতা বললেও অত্যুক্তি হয় না. বাংলার নদ-নদীগুলো এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে. নদীগুলো এদেশকে অসংখ্য ভাগে বিভক্ত করায় অসংখ্য আঞ্চলিক ভাষা আঞ্চলিক সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে.

নদীগুলো এদেশের মানুষকে একদিকে যেমন কষ্টসহিষ্ণু করেছে অপরদিকে তেমনি দার্শনিকও ভাবুক করে তুলেছে. এরফলে সৃষ্টি হয়েছে ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি লোকগানের. বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদী এ অঞ্চলকে গঙ্গেয় উপত্যকার সাথে সংযুক্ত করেছে.এর ফলে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির উপাদানসমূহ বাংলায় প্রবেশ করে এদেশের সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে অসংখ্য নদ-নদী এদেশের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার সহায়ক হওয়ায় নৌপথে আঞ্চলিক বাণিজ্য বিকাশ লাভ করে.এর ফলে বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্য সহজ হয়েছে বাণিজ্যের পথ ধরে এদেশে আসে অসংখ্য ভাগ্যান্বেষী, বিজেতা এবং ধর্মপ্রচারক এদের আগমনের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন এদেশে যারা এসেছে, এদেশের রূপ-সৌন্দর্য আর প্রাচুর্যে বিমোহিত হয়ে এখানে থেকে গেছে কালক্রমে এদেশের রক্তধারার সাথে তারা একাকার হয়ে গেছে.আবার এদেশে ইউরোপীয়দের আগমন ও বিকাশ ঘটেছে এই নদী পথ ধরেই .নদীপথে এদেশের সম্পদ ইউরোপে পাচার করে ইংরেজরা এদেশকে করেছে নঃস্ব. নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে ওঠে. এর ফলে বিকাশ ঘটে কুটির শিল্পের. এদেশের কুটির শিল্পীদের হাতে তৈরি মুসলিম ছিল পৃথিবী বিখ্যাত.এছাড়া নকশী কাঁথা, শীতলপাটি, বাঁশ ও বেতের কারুকাজ এদেশের কারুশিল্পের অনন্য নিদর্শন

নদ নদী ভাঙ্গনের ফলে কিংবা গতিপথ পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন অতীতে বহু সমৃদ্ধ নগর-বন্দর রাজধানী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে সেখানকার কোলাহলপূর্ণ জনজীবন বিরান প্রান্তরে পরিণত হয়েছে অপরদিকে নদী, অপর পাড়ে গড়ে উঠেছে নুতন নুতন শহর, বন্দর ও গঞ্জো.

একসময় গৌড়, তান্ডা,  সাতগাঁও অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগরী ছিল; বর্তমানে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে.

অসংখ্য নদ নদী জলের মতন সারাদেশে ছড়িয়ে থাকায় এদেশের মানুষ নৌকা নির্মাণে ও নৌকা পরিচালনায় দক্ষ হয়ে ওঠে. নৌকা হয়ে ওঠে গ্রাম বাংলার সাধারন বাহন. ঐতিহাসিক আব্দুল ফজল বাঙ্গালীদের নৌকার বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন,

“তারা বিভিন্ন প্রকার নৌকা যুদ্ধের কাজে এবং পরিবহনের কাজে ব্যবহার করে. দুর্গ আক্রমণের জন্য তারা নৌকাগুলো এমনভাবে তৈরি করে যাতে নৌকার  গলুইয়ের অগ্রভাগ দুর্গের উচ্চতা ছাড়িয়ে যায় এবং দুর্গ দখলে সৈন্যদের সুবিধা হয়.

নদ নদী গুলো প্রশাসনিক যোগাযোগে অসামান্য অবদান রেখেছে. সুবা বাংলার রাজধানী ছিল নদীতীরে. গঙ্গার তীরে ছিল রাজমহল তাঁড়া (তাণ্ডা) ও মুর্শিদাবাদ ছিল ভাগীরথী নদীর তীরে আর ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে.

উপরে উল্লেখিত আলোচনা গুলি বাংলাদেশের নদ-নদী বিসিএস ও বাংলাদেশের নদনদী mcq এর জন্য সহায়তা করবে|

 



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

one × two =