বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কাজী ফকির আহমেদ ও জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। তিনি ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে
যোগ দেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিক থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। তিনি করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটান। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুল বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ সালে সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন । তাঁর স্ত্রীর নাম আশালতা সেনগুপ্ত। বিয়ের পর তাঁর নাম পাল্টে রাখেন ‘প্রমীলা’ । ১৯৪২ সালে তিনি ‘পিকস্ ডিজিজ’ নামক মস্তিস্কের ব্যাধিতে আক্রান্ত হন । কাজী নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের যুগ্ম সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ সান্ধ্য পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট তিনি ধূমকেতু পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুইবার প্রকাশিত হত। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন-
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এ বাণী লেখা থাকত। ধূমকেতুর ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশের পর উক্ত সংখ্যা নিষিদ্ধ হয়। একই বছর ২৩ জানুয়ারি ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয় এবং ঐ দিনই তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর বন্দী অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন । এই আনন্দে জেলে বসে নজরুল ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি রচনা করেন । ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জগত্তারিণী’ উপাধি প্রদান করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পদক প্রদান করে। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৪ সালে ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে সাহিত্যে তিনি একুশে পদক লাভ করেন । কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৬ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে প্রথম ঢাকায় আসেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ভারত হতে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে আনা হয় এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয় । ১৯৭৪ সালে এক সংবর্ধনায় তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৬ সালে জানুয়ারি মাসে কবি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ সালে (১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাহী মসজিদ প্রাঙ্গনে তাঁর মাজার অবস্থিত। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন ‘কল্লোল যুগের একজন বিখ্যাত কবি । কাজী নজরুল ইসলামের ছদ্মনাম ছিল ‘ধূমকেতু”। নজরুলের ৫টি গ্রন্থ (যুগবাণী, ভাঙ্গার গান, প্রলয়-শিখা, বিষের বাঁশি, চন্দ্রবিন্দু) সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতির সাথে জড়িত। ‘কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে কবির স্মৃতি বিজড়িত ময়মনসিংহে ত্রিশালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রণসঙ্গীতের রচয়িতা কে ও কোন কাব্যের অন্তর্গত
“চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল…….” গানটি বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। গানটির গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পী হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। গানটি ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থ হতে সংকলিত। ‘নতুনের গান’ শিরোনামে ঢাকার ‘শিখা’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। সাধারণত উৎসব অনুষ্ঠানে রণসঙ্গীতের ২১ চরণ বাজানো হয়।