বিবর্তনের বাস্তবতা প্রমাণিত হওয়ার পর দ্বিতীয় যে প্রাসঙ্গিক বিষয় এসে পড়ে তা হচ্ছে বিবর্তনের পদ্ধতি অর্থাৎ কীভাবে বিবর্তন ঘটে। এ পদ্ধতি ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানের অগ্রগতির উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে একাধিক মতবাদ প্রচলিত হয়েছে । নিচে জৈব বিবর্তনের প্রধান দুটি মতবাদ, ল্যার্মাকবাদ ও ডারউইনবাদ এবং নব্য-ডারউইনবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ল্যামাকিজম বা ল্যামার্কবাদ বা অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার মতবাদ (Lamarckism or Theory of Inheritance of Acquired Characters)
ল্যামার্ক একজন ফরাসী দার্শনিক ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম জাঁ বাপ্টিস্ট পিয়েরে এন্টোইনে দ্য মনেট শেফালিয়ের দ্য ল্যামার্ক (Jean Baptiste Pierre Antoine de Monet Chevalier de Lamarck. (1744-1829)। প্রথমে তিনি ফরাসী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, তারপর উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে জীবন শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে প্রাণীর উপর গবেষণা করেই বেশি সময় ব্যয় করেছেন। তিনি বায়োলজি (Biology) শব্দের প্রবর্তক এবং প্রাণিজগতকে মেরুদন্ডী ও অমেরুদন্ডী এ দুভাগে বিভক্ত করেন। একটি সুসংগঠিত জৈব বিবর্তনবাদের প্রথম প্রবক্তাহিসেবে ল্যামার্ক সুপরিচিত। তাঁর মতবাদটি, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার মতবাদ নামে অভিহিত।
ল্যামার্ক-এর সূত্রসমূহ
ডডসন (Dodson) ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বিবর্তন সম্বন্ধে ল্যামার্ক-এর বিস্তৃত ধারণাকে ৪টি সূত্রের অধীন করে ব্যাখার সুবিধা করে দেন। নিচে সূত্রগুলো উল্লেখ করা হলোঃ
ক। প্রথম সূত্র-বৃদ্ধি ঃ প্রত্যেক জীব তার জীবনকালে অন্তঃজীবনী শক্তির প্রভাবে দেহের আকার এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গের বৃদ্ধি ঘটাতে চায় ।
খ। দ্বিতীয় সূত্র-পরিবেশের প্রভাব এবং জীবের সক্রিয় প্রচেষ্টা ও আঙ্গিক পরিবর্তন ঃ সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজনের জন্য সৃষ্ট অভাববোধের উদ্দীপনা এবং নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে দেহের আঙ্গিক পরিবর্তন ঘটে।
গ। তৃতীয় সূত্র-ব্যবহার ও অব্যবহার ঃ ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে দেহের একটি বিশেষ অঙ্গ সুগঠিত, কার্যক্ষম ও বড় হতে পারে, আবার অব্যবহারে অঙ্গটি ক্রমশ ক্ষুদ্র হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ঘ। চতুর্থ সূত্র-অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার : প্রতিটি জীবের জীবদ্দশায় অর্জিত সকল বৈশিষ্ট্য ভবিষ্যৎ বংশধরে সঞ্চারিত হয়।
ল্যামার্ক-এর সূত্রগুলোর ব্যাখ্যা
ক। বৃদ্ধি ঃ জীবের জীবদ্দশায় অন্তঃজীবনী-শক্তির প্রভাবে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দেহের আকার এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উভয়েরই বৃদ্ধির প্রবণতা রয়েছে। শ্রেণিবিন্যাসের বিভিন্ন ধাপ লক্ষ করলেও এ সত্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন-Cnidaria থেকে Chordata পর্যন্ত প্রাণিগোষ্ঠির প্রত্যেক ধাপেই দেখা যায় দেহাকৃতি বৃদ্ধির একটি সাধারণ প্রবণতা ।
খ। পরিবেশের প্রভাব এবং জীবের সক্রিয় প্রচেষ্টা ও আঙ্গিক পরিবর্তন ঃ পরিবেশ সদা পরিবর্তনশীল । এ পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার জন্য যে অভাববোধের সৃষ্টি হয় তা পূরণের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করায় এবং নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে জীবদেহে নতুন অঙ্গের সৃষ্টি হয় বা অঙ্গের পরিবর্তন ঘটে।
ল্যামার্ক মনে করতেন, পরিবেশ উদ্ভিদকে সরাসরি প্রভাবিত করে ফলে নতুন পরিবেশে দেখা দেয় উদ্ভিদের নতুন অঙ্গ। প্রাণীর বেলায় পরিবেশ প্রাণিদের মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত করে, তখন প্রাণী যা চায় তাই-পায়। যেমন-জিরাফের স্নায়ুতন্ত্রই তাকে বাধ্য করেছে ঘাড় উঁচু করে গাছের পাতা খাওয়ার জন্য।
গ। ব্যবহার ও অব্যবহার ৪ পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার জন্য নতুন সৃষ্ট বা পরিবর্তিত অঙ্গটি যদি জীবদ্দশার পরবর্তী সময়ে ক্রমাগত ব্যবহৃত হয় তা হলে তা সুগঠিত, কার্যক্ষম ও বড় হবে। অন্যদিকে, জীবদ্দশার পরবর্তী সময়ে অঙ্গটির অব্যবহারে তা ক্রমশ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ছোট হতে থাকে, অবশেষে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নিচে
ব্যবহার ও অব্যবহারের উদাহরণ দেওয়া হলো।
ব্যবহার : জিরাফের আদি পুরুষের গলা ও সামনের পা দুটি এখনকার ঘোড়ার মত খাটো ছিল এবং এরা ঘাস বা ছোট ছোট গাছ আহার করতো। বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার পাতা খেতে শুরু করে। উঁচু ডাল-পালা থেকে দৈর্ঘ্য বংশ পরম্পরায় একটু করে বাড়তে থাকে। এভাবে খাটো গ্রীবাধারী পুর্বপুরুষ থেকে বর্তমান যুগের লম্বা গ্রীবাধারী প্রাকৃতিক কারণে চারণভূমির অভাব ঘটলে এরা গাছের উঁচু পাতা খাওয়ার জন্য সৃষ্ট ইচ্ছা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী গলার জিরাফের উদ্ভব ঘটেছে।
অব্যবহার ঃ উটপাখির পূর্ব পুরুষেরা আগে উড়তে পারত। কিন্তু ওদের ডানাদুটি ক্রমাগত অব্যহারের ফলে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
ঘ। অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার ঃ প্রতিটি জীবের জীবদ্দশায় অর্জিত সকল বৈশিষ্ট্য ভবিষ্যৎ বংশধরে সঞ্চারিত হবে। এভাবে, বংশ পরম্পরায় পরিবর্তিত চরিত্র সঞ্চারিত হতে থাকে এবং নতুন নতুন পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য অর্জিত হতে থাকে। ফলে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে একটি প্রজাতির সদস্যদের সাথে এদের পূর্ব পুরুষের আর তেমন মিল থাকে না। অর্থাৎ উদ্ভব ঘটে এক নতুন প্রজাতির।
ল্যামার্কিজমের সমালোচনা
ল্যামার্কের সমকালীন অনেকে সাময়িক স্বীকৃতি দিলেও এ মতবাদ বিজ্ঞানীমহলে অনেক কারণে সমর্থনযোগ্য হয়নি, যেমনঃ ল্যামার্কের ব্যবহার ও অব্যবহার তত্ত্বটি সত্য নয়; কারণ, শিরা ও ধমনি ক্রমাগত ব্যবহৃত হলেও এদের আকার ও আয়তন কখনো বৃদ্ধি পায় না; বারংবার ব্যবহারের ফলে কোন অঙ্গের বৃদ্ধি হয়ত হতে পারে। কিন্তু ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে কোন অঙ্গের নিষ্ক্রিয়তা কিংবা অবলুপ্তির ঘটনাও বিরল নয়; অর্জিত গুণের বংশানুক্রম সমর্থনযোগ্য নয়। লেজ কাটা কুকুরের বাচ্চা জন্যসূত্রে কখনই লেজবিহীন হয় না; অভাব বোধ ও প্রয়োজনের তাগিদে অঙ্গ সৃষ্টির ধারণা সমর্থনযোগ্য নয়। আকাশে উড়বার আকাঙ্খায় কোন মানুষের মনে পাখির মত ডানার জন্য অভাব বোধ মানুষের দেহে কখনো ডানা গঞ্জাবে না; ইন্দ্রিয় সৃষ্টির পূর্বে কোন ইন্দ্রিয়ের জন্য অভাব অনুভূত হওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না; ল্যামার্ক ধারণা করতেন ক্রিয়ার ফলেই কোন অঙ্গের সৃষ্টি হয়। কিন্তু অঙ্গ না থাকলে তার ক্রিয়ার প্রশ্ন অবান্তর।