ভ্যাকসিন (Vaccine) কী এবং কীভাবে কাজ করে?

জীববিজ্ঞান

রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা জীবাণুর নির্যাস বা  জীবাণু  সৃষ্ট পদার্থ(টক্সিন) কিংবা সংশ্লেষিত বিকল্প পদার্থ থেকে উৎপন্ন যে বস্তু এন্টিজেন এর মতন আচরন করে দেহে অ্যান্টিবডি উৎপন্নে উদ্দীপনা জোগায় এবং এক বা একাধিক রোগের বিরুদ্ধে দেহকে অনাক্রম করে তোলে তাকে ভ্যাকসিন (vaccine)বলে.

শরীরে মারাত্মক রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে ভবিষ্যতে ওই সব রোগ দেহকে অসুস্থ করতে পারেনা ভ্যাকসিন প্রয়োগকে টিকা দেওয়া নামে পরিচিত

ভ্যাকসিনের প্রকারভেদ:

উৎপাদনের ধরনের উপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিন নিচে বর্ণিত পাঁচ প্রকার:

নিষ্ক্রিয়:(Inactivated) রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু কে রাসায়নিক, তাপ, বিকিরণ বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় জীবাণু থেকে উৎপন্ন. যেমন ইনফুয়েঞ্জা, কলেরা, পলিও, হেপাটাইটিস এ, প্রভৃতি রোগের ভ্যাকসিন.

শক্তি হ্রাস: (Attenuated)কালসার করা, ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল করে দেওয়া জীবিত জীবাণু দিয়ে উৎপন্ন. যেমন: হাম, পানি বসন্ত, টাইফয়েড রোগের ভ্যাকসিন.

টক্সোয়ড:(Toxoid) জীবাণু নিষ্ক্রিয় বিষাক্ত পদার্থ থেকে উৎপন্ন.যেমন -টিটেনাস, ডিপথেরিয়া প্রভৃতি ভ্যাকসিন.

সাবইউনিট:(Subunit) জীবাণু গাত্রের সামান্য অংশ(নিদিষ্ট প্রোটিনের অংশ) থেকে উৎপন্ন .যেমন- হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন , হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ভ্যাকসিন প্রভৃতি.

কনজুগেট:(Conjugate) দুটি ভিন্ন উপাদানে গঠিত ভ্যাকসিন [ ব্যাকটেরিয়ার দেহ আবরণের অংশ + বাহক প্রোটিন ] যেমন- হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ B(Hib) ভ্যাকসিন.

ভ্যাকসিনেশন(vaccination)

ভ্যাকসিন প্রয়োগ এর মাধ্যমে অনুজীবের, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় কে ভ্যাকসিনেশন বলে.প্রক্রিয়াটি সাধারণত টিকা দেওয়া(inoculation) নামে পরিচিত.নির্দিষ্ট রোগের ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট জীবাণু থেকেই সংগ্রহ ও উৎপন্ন করা হলেও প্রক্রিয়াগত কারণে পদার্থ মানবদেহে কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়া বা রোগ সৃষ্টির পরিবর্তে দেহকে রোগমুক্ত রাখতে, রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে. রোগের চিকিৎসায় ভ্যাকসিনের ব্যবহার.পদ্ধতিকে ভ্যাকসিনোথেরাপি(vaccinotherapy) বলে.

vaccination

ড. এডওয়ার্ড জেনার (Dr. Edward Jenner) 1796 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন আবিষ্কার এর মধ্য দিয়ে যুগান্তকারী ‘ভ্যাকসিন বিপ্লব’ ঘটিয়ে মানুষের রোগ মুক্ত সুন্দর জীবনের যে প্রত্যাশা জাগিয়েছেন তার ধারাবাহিকতায় আজ দ্বিতীয় জেনারেশন(second Generation) ভ্যাকসিন হিসেবে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন উৎপন্ন হয়েছে. কিন্তু AIDS ভ্যাকসিন আজও হয়নি..তবে সম্প্রতি এইডসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কথা শোনা যাচ্ছে তবে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়.

ভ্যাকসিন এর ফলে মানব দেহ এমন সব রোগ থেকে রক্ষা পায় যা থেকে শুধু অসুখ-বিসুখ নয়, দেহ পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে. আমাদের ইনিউতন্ত্রকে বাড়তি শক্তি যোগাতে ভ্যাকসিন নিম্নোক্তভাবে সক্রিয় থাকে.

1.অধিকাংশ ভ্যাকসিনে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সামান্য অংশ থাকে. দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন সক্রিয় জীবাণু থাকে না. কোন কোন ভ্যাকসিন জীবাণু একেবারেই থাকে না.

2.জীবাণুর অংশবিশেষসহ ভ্যাকসিন যে দেহে প্রবেশ করে অ্যান্টিবডি সৃষ্টির মাধ্যমে ওই নির্দিষ্ট জীবাণুর প্রতি দেহকে অনাক্রম্য করে তোলে. এসব অ্যান্টিবডি নির্দিষ্ট রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করে.

3.মানবদেহে দুইভাবেই অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হতে পারে (ক) সুস্থ হলে( খ) ভ্যাকসিন নিলে. জীবাণুর আক্রমণে অসুস্থ হয়ে রোগে ভুগে কষ্ট শেষে এন্টিবডি উৎপাদনের চেয়ে আগেভাগেই সম্ভাব্য রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন গ্রহণ করা বেশি নিরাপদ.কারণ জীবাণুর আক্রমণে দেহ অসুস্থ হলে সম্পূর্ণ নিরোগ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না কারণ দেহ বিকলাঙ্গ হতে পারে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কু্সিত হতে পারে, কিংবা জীবন হানিও ঘুরতে পারে. অতএব ভ্যাকসিনের মতো অস্ত্র থাকতে আমরা কেন দুর্ভোগ পোহাবো?

4.ভ্যাকসিন গ্রহণের ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি দেহে দীর্ঘদিন বা আজীবন উপস্থিত থাকে. অ্যান্টিবডিগুলো জানে কিভাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হয়. অতএব, ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ভবিষ্যতে যদি আসল জীবাণু দেহে প্রবেশ করে তাহলে এন্টিবডির কৌশলের দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র জীবানু ধ্বংসে সক্রিয় হবে

5.অনেক ভ্যাকসিন আছে যা একবার নিলে আজীবন দিয়ে কর্মক্ষম থাকে মাঝে মধ্যে অতিরিক্ত ডোজ(booster shot) নিতে হয়.

6.কিছু কিছু ভ্যাকসিন রয়েছে যা মিশ্র ভ্যাকসিন নামে পরিচিত. এক্ষেত্রে কয়েকটি রোগের ভ্যাকসিন যুক্ত করে দেহে প্রবেশ করানো হয়, যেমন- MMR (Measles, Mumps and Rubella) ভ্যাকসিন.

প্রতিটি মানবদেহে (শিশু বা বয়স্ক)নির্দিষ্ট রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পূর্ণ থাকে. কিন্তু সবার প্রতিরক্ষাতন্ত্র এক ও সবল নয় বলে ভ্যাকসিন এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সবল করা হয়. শিশু বয়সে কয়েকটি রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে পরিবার থাকে নিশ্চিন্ত.

ভ্যাকসিন এর গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা (Importance of vaccines)

শৈশব ও কৈশোর কালীন সময়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়. পোলিও, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়াসহ অন্যান্য মারাত্মক জীবন ঝুঁকিপূর্ণ আজীবন কষ্টকর রোগব্যাধির কবল থেকে নিজের বংশধরকে বাঁচাতে সবাই তৎপর থাকেন. সুস্থ পরিবার ও জাতি গড়তে সুস্থ-সবল বংশধর প্রয়োজন. এ কারণে শৈশবেই ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সবদেশের সরকার বিবেচনা করে থাকে.

ভ্যাকসিন সুষ্ঠুভাবে কাজ করে, এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সামান্য. পৃথিবীতে প্রতিবছর তিন মিলিয়ন লোকের জীবন রক্ষা এবং রোগের কষ্ট থেকে ও স্থায়ী বিকলাঙ্গ হওয়ার থেকে রক্ষা পায় আরো কয়েক মিলিয়ন মানুষ.ভ্যাকসিনে প্রতিরোধযোগ্য হাম, হুপিংকাশি, পোলিও, টাইফয়েড প্রভৃতি যে সম্ভাব্য জটিলতা (হাসপাতালে ভর্তি, অঙ্গচ্ছেদ, মস্তিষ্কের ক্ষত পঙ্গুত্ব, মেনিনজাইটিস, বধিরতা এমনকি মৃত্যু) সৃষ্টি করে তা থেকে মুক্তি পায়.শিশু যদি ভ্যাকসিন না নিয়ে থাকে তাহলে রোগ ব্যাধি অন্য শিশুতে ছড়াতে পারে.এমন শিশু আক্রান্ত হতে পারে যার ভ্যাকসিন প্রয়োগ সম্ভব নয় (যেমন লিউকেমিয়া বা অন্য কোন ক্যান্সার আক্রান্ত, কিংবা অনাক্রম্যতন্ত্রে সমস্যা আছে এমন). শিশুকে ভ্যাকসিন না দিলে রোগব্যাধি প্রচন্ড শক্তি নিয়ে আবার সমাজে ফিরে আসবে ভ্যাক্সিনেশনর ফলে শিশু থাকবে সুস্থ-সবল হাসি-খুশি, অসুখে ভুগে মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকবে না প্রত্যেক পিতা-মাতা ও সন্তানের সুস্বাস্থ্য কামনা করেন. এ আশা পূরণে  ভ্যাকসিনেশন হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা.  অতএব, দুশ্চিন্তাহীন জীবন যাপনের জন্য শুধু নিজের সন্তানকে নয় সমাজে প্রত্যেক পিতা-মাতার কাছে ভ্যাকসিনেশনের প্রয়োজনে তা তুলে ধরা প্রয়োজন.

দেহের প্রতিরক্ষায় স্মৃতি কোষের ভূমিকা

কিছু জমা রাখা এবং প্রয়োজনে তা স্মরণ করার ক্ষমতাকে স্মৃতি (memory)বলে. স্মৃতি সংরক্ষণ এবং যথাসময়ে পুনর্ব্যবহার দেহরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়. প্রতিটি মানুষ প্রতিনিয়ত নানান প্রাকৃতিক আক্রমণকারীর শিকার হচ্ছে.মানব দেহ চোখের আড়ালে সে সব আক্রমণ থেকে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করছে তা আমাদের জানা দরকার. আমাদের দেহ প্রতিরক্ষায় কিভাবে, কোন লেভেলে, কোন প্রহরী ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছে তা জানতে পারলে নিরোগ দেহের প্রয়োজনীয়তা ও দেহ নিরোগ রাখার উপায় উদ্ভাবন সহজতর হবে.প্রতিরক্ষাতন্ত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে অনুজীবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা. যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপরছ (1)সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য অনুপ্রবেশকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষা সাড়া দান করা. এবং (2) অনুপ্রবেশকারীর কথা মনে রাখা. দুই ধরনের কোষ এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে. কোষগুলো সারা দেহে সংবহীত হয়ে অনুপ্রবেশকারী জীবণু খুঁজে বেড়ায় এবং আগের কথা মনে রেখে দ্রুত কার্যকর ভূমিকা পালন করে.জীবাণু সম্বন্ধে আগে থেকে ধারণা  থাকায় রোগ সৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত হয় কিংবা প্রকাশ ঘটলেও তার মাত্রা থাকে সামান্য, অক্ষতিকর পর্যায়ের.দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় স্মৃতিকোষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে.এগুলো এন্টিজেন কে চিহ্নিত এবং মোকাবেলা করে. স্মৃতিকোষ হল লিম্ফোসাইট নামক অদানাদার শ্বেত রক্তকণিকা.

লিম্ফোসাইট দুই ধরনের: T-লিম্ফোসাইটB-লিম্ফোসাইট.

T-লিম্ফোসাইট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে এবং জীবণুকে সরাসরি আক্রমণ করে. অন্যদিকে, B-লিম্ফোসাইট অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে যা জীবণুকে নিষ্ক্রিয় বা ধ্বংস করে. এসব কোষ অস্থিমজ্জায় স্টেমকোষ থেকে.সৃষ্টি হয় এবং লাসিকা বাইকার মাধ্যমে থাইমাস, লাসিকাপর্ব, প্লীহা ও হৃদপিন্ডের কাছাকাছি রক্ত সংবহনতন্ত্রের পৌঁছে পরিণত হয়.

স্মৃতি কোষের(memory T-cell, memory B-cell) প্রধান ভূমিকা হচ্ছে   দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করে অনুপ্রবেশিত জীবাণুর বিরুদ্ধে দেহকে অনাক্রম্য করে তোলা. এভাবে গড়ে ওঠে অর্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা.প্রথমবার কোন জীবাণু দেহে সংক্রমণ ঘটালে দেহ তার বিরুদ্ধে সাড়া দিয়ে যেভাবে রোগমুক্ত হয় তাকে প্রাইমারি সাড়া(primary response) বলে.

আবারও যদি ঐ জীবাণু আক্রমণ করে তখন স্মৃতিকোষগুলো প্রাইমারি সাড়ার স্মৃতিকথা মনে করে দ্রুতর সাড়া দিয়ে দেহকে রোগমুক্ত রাখে. দিত্বীয়বারের সাড়াকে সেকেন্ডারি সাড়া(secondary response) বলে. সেকেন্ডারি সাড়ার কারণে আমরা প্রথম একবার ঘটে যাওয়া সংক্রমণ আর তেমন টের পাই না কিংবা একেবারেই টের পায় না.

দ্বিতীয়বার কোনো জীবাণুর প্রবেশ ঘটলো স্মৃতি T-কোষ আর স্বাভাবিক না থেকে অতিদ্রুত বিপুল সংখ্যক ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের T-লিম্ফোসাইট সৃষ্টি করে জীবাণু ধ্বংস  ঝাঁপিয়ে পড়ে.অন্যদিকে, স্মৃতি B-কোষ মানবদেহের রক্ত প্রবাহে দীর্ঘদিন অতন্দ্র পহরীর মতন সতর্ক থাকে. এ কোষ স্বাভাবিক অবস্থায় এন্টিবডি ক্ষরণ করে না কিন্তু সেকেন্ডারি সাড়ায় অ্যান্টিবডি ক্ষরণকারী বিপুল সংখ্যক কোষ সৃষ্টি করে দেহকে রোগমুক্ত রেখে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে.



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

nineteen − 16 =