ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় সমস্যা

জীববিজ্ঞান

ভ্রূণের বৃদ্ধি ও সন্তান ভূমিষ্ঠের ক্ষেত্রে উন্নত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ভ্রূণের বৃদ্ধি ও সঠির জন্মদানের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯৭% সফল বলে দাবী করেছে CDC (2011)। সমস্ত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে একটি সুস্থ সবল শিশুর জন্মদানে কতখানি সতর্ক থাকতে হয় সে বিষয়ে সাধারণ ধারণা অর্জনের জন্য এখানে ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় কি কি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এবং সাম্প্রতিককালে এসব সমস্যার মোকাবিলার উপায় সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় সমস্যা

ভ্রূণের বৃদ্ধিকালীন সমস্যা অন্তহীন। সমস্ত সমস্যাকে আলোচনার সুবিধার জন্য প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয়।

(১) জিনগত ও ক্রোমোজোমগত সমস্যা এবং (২) টেরাটোজেনজনিত সমস্যা।

১। জিনগত ও ক্রোমোজোমগত সমস্যা (Genetic and Chromosomal Problems ) প্রকট ও প্রচ্ছন্ন জিনের কারণে জন্মের শুরুতেই সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। অটোসোমের মধ্যে অবস্থিত জিনগুলে অটোসোমাল ব্যাধি (autosomal disorder)-র সৃষ্টি করে। X-ক্রোমোজোমে অবস্থিত জিনগুলোর কর্মকান্ডে দেখা দেয় সেক্স-লিংকড রোগব্যাধি। নিচে কয়েকটি ব্যধির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।

অটোসোমাল ব্যাধি ঃ অধিকাংশ প্রচ্ছন্ন অটোসোমাল রোগের বিকাশ ভূণে হলেও প্রকাশ ঘটে জন্মের ঠিক পর মুহূর্তে বা শিশু বয়সে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দশ হাজার শিশুর মধ্যে একজনে এমন একটি অসুখ দেখা যায় যা একটি প্রচ্ছন্ন জিনের কারণে হয়ে থাকে। এ জিনের প্রভাবে শিশু ফিনাইল অ্যালানিন নামক অ্যামিনো এসিড হজম করতে পারে না। এ কারণে মস্তিষ্কে বিষাক্ত পদার্থ জমা হয়ে শিশুকে মানসিক প্রতিবন্ধিতে পরিণত করে। এ অসুখের নাম
ফিনাইলকিটোনিউরিয়া (Phenylketonuria, সংক্ষেপে PKU)। ঐ নির্দিষ্ট অ্যামিনো এসিডবিহীন খাদ্য গ্রহণ করলে কোনো সমস্যা হবে না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক রাজ্যে শিশু ভূমিষ্ঠের পরপরই PKU পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক। প্রচ্ছন্ন জিনগত ব্যাধির মধ্যে সিকল সেল (Sickle-cell), টে-স্যাকস (Tay-sachs) প্রভৃতিও রয়েছে। প্রকট জিনের ব্যাধি হিসেবে হ্যান্টিংটন-স ব্যাধি (Huntington’s disease) বিখ্যাত। এ রোগ আবার শিশু পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত প্রকাশ পায় না। এতে মস্তিষ্কের অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও স্নায়বিক বৈকল্য ত্বরান্বিত হয়। রোগ শনাক্তের জন্য আগে শিশুকে পূর্ণবয়স্ক হতে হতো, এখন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আরো আগেই শনাক্ত করা যায়।

সেক্স-লিংকড ব্যাধি ঃ লাল-সবুজ বর্ণান্ধতা ও হিমোফিলিয়া এ দুটি অতিপরিচিত সেক্স-লিংকড ব্যাধি। প্রচ্ছন্ন জিনের কারণে এ অসুখ হয়। আরেকটি অসুখ আছে তার নাম ফ্র্যাজাইল-X সিন্ড্রোম (Fragile-X Syndrome)। প্রতি চার জোর পুরুষের একজন আর প্রতি আট হাজার নারীর একজন এ অসুখে ভোগে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি X ক্রমোজোমে ভঙ্কুর বা ক্ষতিগ্রস্ত একটি জায়গা আছে। শিশুর বয়স যতো বাড়ে অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্টতার মাত্রা ততো কমে যায়। কারণ এটি মানসিক প্রতিবন্ধিগত এবং অটিজম (autism)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কিত রোগ।

ট্রাইসোমিঃ এটি ক্রোমোজোমঘটিত অন্যতম রোগ। ক্রোমোজোমের বিশৃঙ্খল আচরণে অর্ধশতাধিক অসুখে মানুষ ভোগে এবং এসব রোগের অধিকাংশের প্রতিক্রিয়ার ফলে গর্ভপাত ঘটে থাকে। ট্রাইসোমি( trisomy) এমন এক অবস্থা যখন ভুক্তভোগী নির্দিষ্ট অটোসোমের ৩ কপি বহন করে। যেমন সবচেয়ে পরিচিত ডাউন সিন্ড্রোম (একে ট্রাইসোমি 21-ও বলে) ।   এ ক্ষেত্রে শিশুদেহে ক্রোমোজোম 21-এর তিনটি কপি থাকে। এ ধরনের জটিলতা নিয়ে ৮০০-১০০০ শিশুর মস্তিষ্কের ছোট আকৃতি, হৃদরোগ প্রভৃতি জটিলতা নিয়ে চরম মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে শিশু জন্ম নেয়, বেড়ে উঠে।

২। টেরাটোজেনজনিত সমস্যা (Teratogens)
সফল গর্ভধারণই সুস্থ শিশুর জন্মদানের একমাত্র উপায় নয়। ভ্রূণের বৃদ্ধি কোন পরিবেশে হচ্ছে সে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত। মনে রাখতে হবে, ভ্ৰূণ এমন কোনো অবস্থায় থাকে যা পরিবেশের আওতার হাইরে। এ কারণে, দূষিত বহিঃপরিবেশ, মায়ের অসুস্থতা ও ওষুধ গ্রহণ কিংবা মাদক সেবন সবকিছুতে ভূণের বৃদ্ধি প্রভাবিত হয়। ভ্রূণ বৃদ্ধির প্রায় শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে যখন এটি বিভিন্ন অঙ্গতন্ত্রে সজ্জিত ফিটাসে
পরিণত হবে সে সময়কালটি সবচেয়ে বেশি বিপদসংকুল। তখন বিভিন্ন পরিবেশিক কারণে অঙ্গবিকৃতি বা অঙ্গহানি ঘটে । এ সব বিকৃতি বা হানি-র জন্য যে কারণগুলো দায়ী সেগুলোই হচ্ছে টেরাটোজেন। নিচে কতকগুলো টেরাটোজেন ও মানবস্তূণে তার কুফল আলোচনা করা হলো।

রুবেলা / জার্মান হাম (Rubella / German Measles) : ভূণাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ভ্রূণের গর্ভপাত ঘটে কিংবা ভূমিষ্ঠ হলেও অন্ধ, বধির, মানসিক প্রতিবন্ধী, হৃৎপিন্ড ও স্নায়ুতন্ত্রে ত্রুটি নিয়ে জন্মায়।

HIV ও হেপাটাইটিস B ঃ এ ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত মাতৃদেহে বর্ধনশীল ভূণ জন্মগত অঙ্গবিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, বরং জীবনহরণকারী সংক্রমণ হিসেবে পরিচিত।

সাইটোমেগালোভাইরাস (Cytomegalovirus, CMV) ঃ এটি হারপিস গ্রুপভুক্ত ভাইরাস। পূর্ণবয়স্ক মানুষে এ ভাইরাস কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ প্রকাশ করে না বলে এর উপস্থিতি সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। কিন্তু সন্তান জন্মগত পঙ্গু হয়ে জন্মায়। সিফিলিসের সংক্রমণে শিশু চোখ, কান ও মস্তিষ্কের খুঁত নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়।

দীর্ঘকালীন অসুস্থতা (Chronic illness) : হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও লুপাস (lupus) নামে চর্মক্ষত রোগ, ভূণের পরিস্ফুটনে প্রভাব ফেলে। ডায়াবেটিক মা’দের বিপাকীয় তারতম্যের কারণে যেভাবে রক্তে চিনির মাত্রার তারতম্য ঘটে এবং তার মাত্রা সঠিক রাখতে সুচিন্তিত ব্যবস্থা না নিলে ভ্রূণের স্নায়ুতন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ধূমপান (Smoking) ঃ ধূমপায়ী মায়ের ভূণ বৃদ্ধিকালীন সময়ে মারাত্মক পুষ্টি সংকটে ভোগে ফলে কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তামাক (সিগারেট) জাতীয় দ্রব্যাদির প্রধান উপাদান নিকোটিন। নিকোটিন রক্তবাহিকার নালি সংকুচিত করে দেয় ফলে অমরায় রক্ত প্রবাহ ও পুষ্টি পদার্থের পরিমাণ কমে যায়, ভূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

মদপানঃ বর্ধনশীল ভূণকে গর্ভে ধারণ করে অবাধে মদপান করলে ভূমিষ্ঠ শিশু যে অসুখে ভোগ তার নাম ফিটাল আলকোহল সিন্ড্রোম (Foctal Alcohol Syndrome, সংক্ষেপে FAS)। যে মায়েরা অতিরিক্ত মদ্যপায়ী মালকোহলিক তাদের গর্ভস্থ ভ্রূণ যে সব ক্ষতির সম্মুখীন হয় তার প্রকাশ ঘটে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর।

খাদ্যগ্রহণ ঃ গর্ভবতী মায়ের খাদ্য গ্রহণের বিষয়টি সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। শিক্ষিত- অশিক্ষিত সবাই অন্ততঃ এ বিষয়ে সজাগ যে ভ্রূণের স্বাভাবিক ও সুস্থ বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর ও বাড়তি খাবার প্রয়োজন। গবেষণার আলোকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় নিউরাল নালির পরিস্ফুটনে ফলিক এসিডযুক্ত খাদ্য গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। কোনো নারীর গর্ভসঞ্চার হয়েছে কিংবা তা জানার আগেই ভ্রূণের নিউরাল নালির পরিস্ফুটন শুরু হয়ে যায়। অতএব, আহারের বাছ-বিচার অত্যন্ত জরুরী।

মানসিক অবস্থা ঃ ভূণের বৃদ্ধিকালিন সময়কালটি বাংলাদেশের ধনী-গরীব সব পরিবরাই সচেষ্ট থাকে যেন মা ও শিশু সুস্থ থাকে। পরিবারে বয়স্ক সদস্যের নির্দেশও থাকে যেন মায়ের মন সবসময় আনন্দে থাকে। আধুনিক যান্ত্রিক যুগেও এটি প্রমাণিত হয়েছে যে প্রফুল্ল থাকা মায়ের ভূণ যেভাবে বর্ধিত হয় বিষণ্ন মায়ের ভূণ তেমনটি হয় না।

পরিবেশিক ঝুঁকি (Environmental hazards) : কিছু পরিবেশিক উপাদান ভ্রূণের বৃদ্ধিতে মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে নারীরা পারদ নিয়ে কাজ করে (দন্তচিকিৎসক, দন্তকৌশলী, সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন কর্মী) তারা যেন এসব মারাত্মক টেরাটোজেনিক পদার্থ থেকে দূরে থাকে সে পরামর্শ দেওয়া হয়। যারা প্রচুর মাছ খায় তাদেরও পরামর্শ দেওয়া হয় বেশি মাছ না খেতে কারণ নদী-নালা-সমুদ্র সমস্ত জলাভূমি শিল্পবর্জ্যের দূষণে দূষিত। এখানকার মাছের শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় পারদ থাকে। শিল্পবর্জ্যের আরেক দুষক হচ্ছে পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইলস (Polychlorinated biphenyls, PCB)। এসব পদার্থ মাছের শরীরে জমা হয়। এ কারণে গবেষকদের নির্দেশ হচ্ছে ভ্রূণের সুস্থ ও স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্যে, বিশেষ করে টুনা, হাঙ্গর, তরবারি মাছ (সোর্ডফিশ), ম্যাকরেল প্রভৃতি মাছ এবং দূষিত নদীর মাছ না খাওয়া। 



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

eleven − 7 =