সূচনা : বর্তমান যুগে মানবজীবনের মূল চালিকাশক্তিই হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞান মানুষকে সংস্কার থেকে মুক্তি দিয়েছে, বদলে দিয়েছে তার জীবনের গতি ও প্রকৃতি। এককালে মানুষ যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, বিজ্ঞান আজ তাকেই বাস্তবে রূপদান করেছে। অজানাকে জানার অদম্য আগ্রহ থেকে মানুষ আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানের নতুন নতুন জগৎ। যে প্রকৃতির হাতে একদিন মানুষ ছিল অসহায়, সেই প্রকৃতির অন্ধশক্তিকে পরাভূত করে তাকেই সে আজ ব্যবহার করছে নিজের প্রয়োজনে। প্রকৃতির সীমাহীন রহস্যকে উদ্ঘাটন করে বিজ্ঞান মানবজীবনে এনে দিয়েছে কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। বিজ্ঞানের কল্যাণে জলে-স্থলে-নভোতলে মানুষের আজ অপ্রতিহত জয়যাত্রা।
বিজ্ঞানের বহুমুখী অবদান : বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের অবদান বহুমুখী ও ব্যাপক। আমাদের জীবনের সর্বস্তরে বিজ্ঞানের প্রভাব লক্ষ করা যায়। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে, তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, যোগাযোগ, কৃষি ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান আজ কল্যাণকর ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে মানবজীবন কল্পনাই করা যায় না।
পারিবারিক ও পৌরজীবনে বিজ্ঞান : আদিম যুগের মানুষ এক শুভলগ্নে উদ্ভাবন করেছিল আগুন জ্বালানোর কৌশল। বিজ্ঞানের কল্যাণে সে মানুষ ক্রমে বিদ্যুতের যুগে এসে পৌঁছেছে। মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করেছিলেন বিদ্যুৎ। টমাস এডিসন তাকে নানা কাজে প্রয়োগ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যুৎ আবিষ্করের পর থেকেই ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন কলাকৌশল। ঘর-গৃহস্থালির কত রকম কাজে বিজ্ঞান শক্তিকে আমরা যে কত বিচিত্রভাবে ব্যবহার করি, তা বলে শেষ করা যায় না। কুকার, হিটার, গ্যাস বার্নার, বৈদ্যুতিক বাতি, বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, এয়ার কন্ডিশনার, রিফ্রিজারেটর আমাদের পারিবারিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি করেছে। প্রশস্ত সড়ক ও দালান-ইমারত নির্মাণ, বৈদ্যুতিক লিফ্ট্স্থা পন, বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ইত্যাদি নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিজ্ঞানের বদৌলতেই সম্ভবপর হয়েছে।
শিক্ষা ও বিনোদনে বিজ্ঞান : শিক্ষা মানবসভ্যতার মূল চাবিকাঠি। এই শিক্ষা বিস্তারে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। কাগজের আবিষ্কার, মুদ্রণযন্ত্র ও ছাখাপাখানার উদ্ভাবন শিক্ষার অগ্রগতিকে তুরান্বিত করেছে। ছাপাখানায় বিদ্যুতের ব্যবহার এবং সাম্প্রতিককালে কম্প্যুটার প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যাপক হারে বই-পুস্তকের মুদ্রণ সহজসাধ্য হয়েছে। আমাদের জীবনে বিনোদনের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের সক্রিয় ভূমিকা অনস্বীকার্য। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, সি.ডি. ডি.ভি.ডি., ভি.সি.আর., স্টেরিও, রেকর্ড প্লেয়ার, টেপরেকর্ডার ইত্যাদি বিচিত্র উপকরণ বিজ্ঞানেরই অবদান।
শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা মিটাতে গিয়ে মানুষের জীবনে অসংখ্য দ্রব্য- সামগ্রীর প্রয়োজন পড়ে। এ সকল সামগ্রী উৎপাদিত হয় বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানায়। আর এ জাতীয় কল-কারখানা মাত্রই বিজ্ঞানেরই সৃষ্টি। খরস্রোতা নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন, ভূগর্ভ ও সমুদ্রতল থেকে গ্যাস উত্তোলন, পরিবর্তন সাধন করেছে। ট্র্যাক্টর, পাওয়ার টিলার, গভীর নলকূপ, ওয়াটার পাম্প, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির কল্যাণে মরুভূমির বুক চিরে তেল ও সোনা আহরণ— এসবই সম্ভব হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ফলে। কৃষি ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান আজ বৈপ্লবিক কৃষিব্যবস্থায় আজ গতি সঞ্চারিত হয়েছে। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে কৃষিজমিকে দু’ফসলা ও ত্রিফসলা জমিতে রূপান্তরিত করে বহু দেশের মানুষ খাদ্য সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভ করেছে।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : যোগাযোগ বলতে সাধারণত যাতায়াত ব্যবস্থা ও সংবাদ-তথ্য আদান-প্রদানকেই বোঝায়। যাতায়াতের ক্ষেত্রে নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের ভ্রমণকে দ্রুত ও সহজতর করেছে। পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করছে মানুষ, সমুদ্রের নিচ দিয়ে তৈরি করছে সুড়ঙ্গ পথ, ভূগর্ভে বসিয়েছে পাতাল-রেল। আন্তঃমহাদেশীয় মহাসড়ক, দীর্ঘ বহুমুখী সেতু ইত্যাদির কল্যাণে মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। জেম্স্ ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন ও জর্জ স্টিফেনসনের রেলগাড়ি আবিষ্কার মানবসভ্যতায় যুগান্তকারী ঘটনা। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আকাশে ওড়ার স্বপ্নকে আধুনিক বিজ্ঞান জেট, বোয়িং ও কনকর্ডে এনে পৌঁছে দিয়েছে। সংবাদ আদান প্রদানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতি অবিস্মরণীয়। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, টেলিপ্রিন্টার, ফ্যাক্স, রেডিও, রাডার, ই-মেইল, টেলিভিশন, উপগ্রহ, সংবাদপত্র ইত্যাদি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সংবাদ সংগ্রহ, প্রচার ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সুযোগ সৃষ্টি করেছে। রাডার ও উপগ্রহের মাধ্যমে আবহাওয়াবিদরা ঝড়-তুফানের সম্ভাব্যতা নিরূপণ করতে পারেন। এভাবে বিজ্ঞান আজ সময় ও দূরত্বকে জয় করতে পেরেছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে মানবজাতিকে বাঁচাবার লক্ষ্যে বিজ্ঞানীদের অব্যাহত গবেষণার ফলে বহু জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, রেডিয়াম ইত্যাদির আবিষ্কার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে আশার আলো সঞ্চারিত করেছে। এক্স-রে, এন্ডোস্কোপি, আলট্রাসনোগ্রাফি, এম.আর.আই., পারমাণবিক স্ক্যানিং, সি.টি. স্ক্যান ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থার সাহায্যে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মানুষ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। যক্ষ্মা, হাম, বসন্ত, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, কলেরা, পোলিও এবং ধনুষ্টঙ্কারের টিকা আবিষ্কার করে বিজ্ঞানীরা এসব দুরারোগ্য ব্যাধি প্রায় নির্মূল করেছেন। পারমাণবিক চিকিৎসা, রেডিওথেরাপি, লেজার রে ইত্যাদি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভিনব সংযোজন। শল্য চিকিৎসায়ও আজকাল এসেছে যুগান্তর। হূৎপিণ্ড, কিড্নি ও চোখের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন এবং প্লাস্টিক সার্জারি আধুনিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান : শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র, কম্প্যুটার, মহাশূন্যযান ও উপগ্রহ স্থাপন প্রযুক্তি আবিষ্কার মানবজাতিকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ মনে করত কম্প্যুটার শুধু হিসাব কষার কাজেই ব্যবহৃত হবে। কিন্তু বর্তমানে এর উপযোগিতা ও কাজের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। মহাশূন্য অভিযানে বিজ্ঞানের সাফল্য ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। মানুষ চাঁদের পিঠে অবতরণ করেছে— পৃথিবীতে বসে চাঁদে দাঁড়ানো অভিযাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে; রকেট পাঠিয়েছে মঙ্গলগ্রহে।
বিজ্ঞানের অভিশাপ : বিজ্ঞান শুধু যে কল্যাণ করে চলেছে তা নয়, অনেক অকল্যাণেরও সে জন্ম দিয়েছে। যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ ক্রমশ শ্রমবিমুখ ও আরামপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সে মানসিক পরিশ্রমের তুলনায় কায়িক পরিশ্রম করছে অনেক কম। ফলে জীবনে নানা রোগ-ব্যাধির আক্রমণে তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে চলেছে। যন্ত্রশক্তির ওপর অন্ধ আস্থা স্থাপন করতে গিয়ে মানুষ চিন্তা-চেতনায় যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। টেলিভিশনের কিছু কিছু রুচিহীন অনুষ্ঠান কিশোর- কিশোরীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সমাজে নৈতিক অধঃপতন ঘটাচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক দ্রব্যাদির অতি ব্যবহারের কারণে মানুষের খাদ্যশস্যের গুণগত মান বিঘ্নিত হচ্ছে। এটি এখন মানব স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার সাহায্যে ধ্বংসের যে তা-বলীলা চালানো হয়েছে, পৃথিবী আজও তা তীব্র ঘৃণা ও আতঙ্কের সঙ্গে স্মরণ করে। বর্তমানে বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে অসংখ্য পারমাণবিক বোমা ও মারণাস্ত্র মজুদ আছে। এ সকল মারণাস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে পৃথিবীতে প্রতিনিয়তই পরিবেশ-দূষণ ঘটছে। গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার ভয়াবহ পরিণতির কথা ভেবে মানবজাতি আজ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।
উপসংহার : আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের জয়যাত্রারই ইতিহাস। বিজ্ঞানের অপার শক্তি দিন দিন আমাদের সামনে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দিচ্ছে। আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার মাধ্যমে এই বিজ্ঞান-শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা জীবনের বহু সংকট ও সমস্যার সমাধান করতে পারি। মানবসভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে এমন মারণাস্ত্র তৈরিতে ও মহাশূন্যে অনাবশ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উন্নত বিশ্ব যে সীমাহীন অর্থ ব্যয় করে, তা দিয়ে ক্ষুধায় কাতর তৃতীয়-বিশ্বের আর্তমানব সমাজকে সহজেই দারিদ্র্যমুক্ত করা যায়। বিজ্ঞানের নিঃস্বার্থ ও গঠনমূলক প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তি।