মানুষে অনেক ধরনের বংশগত রোগ দেখা যায়। এসব রোগ জেনেটিক বা জিনঘটিত রোগ-ব্যাধি নামে পরিচিত । মাসক্যুলার ডিসট্রফিও একটি জিনঘটিত রোগ। প্রধানত কঙ্কালিক ও হৃৎপেশি এবং কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে এ রোগ দেখা যায় । একটি সেক্স-লিংকড জিনের বিশৃঙ্খলার কারণে প্রধানত শিশুদেহে প্রকাশিত হাত, পা, দেহকান্ড, হৃৎপিন্ড ও আন্ত্রিক পেশির সঞ্চালন ও স্বাভাবিক কাজকর্মের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে যে দুর্বিসহ জীবনের সূত্রপাত ঘটায় সেটি হচ্ছে মাসক্যুলার ডিসট্রফি নামে এ বংশগত রোগ। অসুখটি ছেলে শিশুদের বেশি হয়।
তিরিশের বেশি ধরনের মাসক্যুলার ডিসট্রফি দেখা যায়। এর মধ্যে ৯টি হচ্ছে প্রধান বাকিগুলো দুর্লভ। দেহের আক্রান্ত ও আশ-পাশের অংশ, পেশি দুর্বলতার ধরণ, কোন বয়সে দেখা দেয় এবং রোগের গতিধারা একেক রকম। রোগের সাধারণ শারীরিক লক্ষণগুলো হচ্ছে- পেশির দুর্বলতা ও সমন্বয়ের অভাব; স্থূলতা দেখা দেওয়া; দ্রুত পেশিক্ষয়, দুর্বলতা ও পেশি অকার্যকর হওয়া; অস্থিসন্ধির কুঞ্চন; কপালের উপরে টাক হওয়া (frontal broldness); চোখে ছানি পড়া; চোখের পাতা ঝুঁকে পড়া; মানসিক অস্বাভাবিকতা; জননাঙ্গের ক্ষয়িষ্ণুতা প্রভৃতি।
মাসক্যুলার ডিসট্রফিযুক্ত শিশুদের বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুদের মানসিক উঠা-নামা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তখন সব শিশুর জন্যই কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার দরকার পড়ে না। নিম্নোক্ত আচরণগত বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে অভিভাবককে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে :
১. স্কুলে আচরণগত সমস্যা ও দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করায় সমস্যা সম্বন্ধে শিক্ষকদের রিপোর্ট।
২. অবিভাবক বা সেবাদানকারীর উপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়া।
৩.মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, হাঁটতে না চাওয়া ।
৪. অসুখ সম্বন্ধে হতাশ ও আবেগতাড়িত হয়ে পড়া।
৫. ঘন ঘন বদমেজাজ দেখানো।
৬. ওষুধ খাওয়া বা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপার প্রতিরোধ করা বা এড়িয়ে চলা এবং
৭. নিজের বয়সী শিশুদের কর্মকান্ডে অংশ না নেওয়া বা জমায়েতে শরীক না হওয়া।
মাসকুল্যার ডিসট্রফি একটি দুর্লভ জিনঘটিত অসুখ। আগেই বলা হয়েছে যে তিরিশেরও বেশি ধরনের মাসক্যুলার ডিসট্রফি রয়েছে। এর মধ্যে ডুশেনি মাসক্যুলার ডিস্ট্রফি (Duchenne Muscular Dystrophy সংক্ষেপে DMD) হচ্ছে ভয়াবহতম ডিসট্রফি। পুঞ্চাশ হাজারে (৫০,০০০- এ) মাত্র একজনে এ রোগটি দেখা যেতে পারে। অন্য ডিসট্রফিগুলো আরও দুর্লভ। মাসক্যুলার ডিস্ট্রফির সঙ্গে বোধশক্তিজনিত প্রতিক্রিয়ার সামান্য সম্পর্ক রয়েছে। কোনো শিশু যদি অনুগ্র মানসিক প্রতিবন্ধী (mild intellectual disable) বিশিষ্ট হয় এবং মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে ভোগে তাহলে সে স্বাভাবিক মানুষের মতোই লেখা-পড়া ও চাকুরি করতে পারবে, এমনকি সাধারণ মানুষের মতো যানবাহনে চলাফেরাও করতে পারবে। মাঝারি (moderate) ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধী হলে ওসব কাজে সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। কিন্তু তীব্র (very) মানসিক প্রতিবন্ধী বিশিষ্ট মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে ভোগে এমন শিশু অটিজম (autism)-এর দিকে ধাবিত হতে পারে।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, জেনেটিক বিশৃঙ্খলজনিত এ রোগটির কোনো চিকিৎসা নেই । গবেষকরা মাসক্যুলার ডিসট্রফি সৃষ্টিকারী পরিব্যক্ত (mutated) জিন সংশোধনের জন্য জেনেটিক থেরাপি আবিষ্কারের উদ্দেশে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। গবেষণার লক্ষ হচ্ছে অস্থিসন্ধির বিকৃতিরোধ করা, সঞ্চালন ক্ষমতা বাড়ানো এবং রোগীকে যন্ত্রণামুক্ত দীর্ঘায়ু করে তোলা। তবে বর্তমানে পেশির দুর্বলতা, আক্ষেপ, কাঠিন্য প্রভৃতি উপশমে বিভিন্ন ওষুধের প্রচলন রয়েছে (যেমন মেক্সিলেটিন, ব্যাকলোফেন, কার্বঅ্যামেজপাইন ইত্যাদি)।
X ক্রোমোজোমে অবস্থিত কোনো জিন যদি পরিব্যক্ত হয়ে অপত্য বংশে সঞ্চারিত হয় এবং রোগের প্রকাশ ঘটায় তবে সে ব্যক্তিকে X-লিংকড ব্যাধি নামে অভিহিত করা হয়। পুরুষে যেহেতু একটিমাত্র X ক্রোমোজোম থাকে তাই এসব রোগ-ব্যাধি কেবল পুরুষেই সীমাবদ্ধ থাকে। পুরুষে আরেকটি X কোমোজোমের পরিবর্তে যেহেতু Y কোমোজোম থাকে তাই মাসুক্যুলার ডিসট্রফির জন্য দায়ী ডিসট্রফিন জিন-এর আর কপি থাকে না।
নারীদেহে দুটি X কোমোজোম (XX) থাকে। অতএব একটি X ক্রোমোজোমের জিন বিকৃত হলে অন্য X
ক্রোমোজোমে অবস্থিত স্বাভাবিক জিনটি ব্যাকআপ কপি হিসেবে কাজ করে। নারী পরিব্যক্ত X-লিংকড জিন বহন করলেও তার দেহে X-লিংকড রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাবে না, তবে ঐ নারী রোগের বাহক হিসেবে কাজ করবে এবং ওই জিন তার পুত্র-সন্তানে সঞ্চারিত করবে। প্রত্যেক পুত্র সন্তান অস্বাভাবিক এ জিন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার
এবং রোগগ্রস্ত হওয়ার ৫০% সম্ভাবনা বহন করে। কন্যা সন্তানদের উত্তরাধিকার সূত্রে বহন এবং রোগের বাহক হিসেবে ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা থাকবে ৫০%।
X ক্রোমোজোমে স্বতঃস্ফূর্ত পরিব্যক্তি (mutation)-র ফলে পুত্র সন্তানে X-লিংকড প্রচ্ছন্ন রোগের সৃষ্টি করে।
মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে জিনের ভূমিকা ঃ দেহে প্রায় ৩ হাজার পেশি-প্রোটিন রয়েছে। প্রত্যেকটি প্রোটিন একেকটি জিন-এ রক্ষিত থাকে। কিছু পেশি-প্রোটিন পেশিতন্তুর গাঠনিক অংশ, অন্যগুলো পেশিতন্তুতে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। একটি পেশি-প্রোটিন জিনে সামান্য বিকৃতিও পেশিরোগের প্রকৃতি ও ভয়াবহতাকে প্রভাবিত করে। যেমন-ডিসট্রফিন প্রোটিন উৎপন্নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত জিনে কিছু বিকৃতি বা পরিবর্তন ঘটার ফলে তীব্র পেশি-ক্ষয়িষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে। এ ধরনের অবস্থার্কে ডুসেনি মাসক্যুলার ডিসট্রফি বলে । অন্য ক্ষেত্রে হয়তো রোগের অবস্থা তেমন ব্যাপক হয় না। আবার অন্যান্য ধরনের মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে ডিসট্রফিন জিনে নয় বরং অন্যান্য জিনে মিউটেশন (পরিব্যক্তি) ঘটতে দেখা যায়।