মৌমাছির সামাজিক সংগঠন

জীববিজ্ঞান

প্রত্যেকটি মৌচাকে মৌমাছিরা বসতিবদ্ধ হয়ে একটি বড় পরিবার বা সমাজ গড়ে বাস করে। আকার-আকৃতি ও কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিরা তিন সম্প্রদায়ে বিভক্ত ঃ ১। রাণী মৌমাছি যা একমাত্র উর্বর মৌমাছি; ২। ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি; এবং ৩। কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছি।

একটি মৌবসতিতে ৩ সম্প্রদায়ের) মৌমাছি মিলে-মিশে এক অনন্য সমাজ গড়ে তুলেছে। প্রতিটিতে একটি রাণী
মৌমাছি, কয়েকশ পুরুষ মৌমাছি এবং ২০-৮০ হাজার কখনওবা লক্ষাধিক কর্মী মৌমাছি থাকে ।

মৌমাছি সামাজিক প্রাণী। একেকটি বড় পরিবার গড়ে বা বসতবদ্ধ হয়ে মৌচাক বাস করে। প্রত্যেকটি কলোনিতে মৌমাছির ৩টি সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সামাজিক উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলে । একটি মাত্র রাণীর নেতৃত্ব কয়েকশ’ ড্রোন ( বা পুরুষ মৌমাছি) এবং ঋতুভেদে ১০- ৮০ হাজার কর্মী মৌমাছি (বন্ধ্যা স্ত্রী মৌমাছি) যে সুশৃঙ্খল উপায়ে নীরবে নিভৃতে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে তা লক্ষ বছর ধরে মানুষ জানবার চেষ্টা করেছে। তাদের এ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা মৌমাছি গোষ্ঠীর সকল মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে প্রাণিজগতে অনন্য নজির স্থাপন করেছে। নিচে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপব্যবস্থাবলীর মাধ্যমে মৌমাছিরা দৃঢ় সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে বাস করে ।

১। শ্রম বন্টন ঃ কর্মীদের মধ্যে অস্থায়ী দায়িত্ব বণ্টন মৌমাছি কলোনির এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কর্মী মৌমাছির আচরণ সাধারণত বয়স, চাকের অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। কলোনিবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মী মৌমাছিদের শৈশব বলতে কিছু নেই। ৩-৪ দিন বয়সেই তারা চাকের মধু-কুঠুরি পরিষ্কারের কাজে লেগে যায়। ১৮-২০ দিন বয়স হলে মধু আহরণে বের হয়। এর পূর্ব পর্যন্ত তারা রক্ষী হিসেবে বাসা পাহাড়া দেয়। শেষ বয়সে কর্মী মৌমাছি পানি বহন করে, অবসর যাপন করে এবং বেশি দূরে যায় না। বিবর্তনের গতিপথে তারা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণের অধিকারী হয়েছে, যথা- বহিঃপরিবেশগত অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন ঘটলে কলোনির স্বার্থে বয়স নির্বিশেষে সবাই এক কাজ ছেড়ে অন্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেক সময় বাইরে অবস্থানরত মৌমাছিরা ঝড়-বাদলে আটকা পড়ে কলোনিতে ফিরতে পারে না, কিংবা শস্যক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ক্রিয়ায় অনেকে মারা গেলে বয়স অনুযায়ী কাজের ধারা বিঘ্নিত হয়। তরুণ সদস্যরা সুধা আহরণের গতিকে কখনও ছিন্ন হতে দেয় না ।

২। খাদ্যের যোগান ঃ যে কোনো সমাজের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য। মৌ-নেতৃত্ব এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ আপোষহীন । দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষ করে শীতকালে এবং প্রতিদিনকার খাদ্যের সংস্থান ও মজুত গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি কলোনির অগণিত কর্মী মৌমাছি সকাল-সন্ধ্যা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলে । মৌচাকের এক নির্দিষ্ট স্থানে নিজেদের জন্য এবং ভাবী বংশধরদের জন্য খাদ্য জমিয়ে রাখে।

৩। ভাব বিনিময় ; সুশৃঙ্খলতাই একটি জাতির সমৃদ্ধি ও উন্নতির চাবিকাঠি। মৌমাছির কলোনি প্রাণিজগতের
অন্যতম সুশৃঙ্খলতম ও আদর্শ গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত। মৌমাছিরা তাদের ভাবাবেগ কিছুটা প্রকাশ করে গুঞ্জনের মধ্যে দিয়ে পরস্পরের মধ্যে ভাববিনিময় করে গন্ধবস্তু ও বিশেষ নৃত্য-ভঙ্গিমায় । রাণী মৌমাছির ত্বক-নিঃসৃত হরমোনের গুণযুক্ত এসিড চাকের সবখানে বিসরিত হয়ে সকল মৌমাছির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দিষ্ট ধরনের গতিবিধি বা মৌ-নৃত্য কলোনির মৌমাছিদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের অন্যতম প্রধান উপায়। সন্ধানী কর্মী মৌমাছিরা বাইরে থেকে এসে বিশেষ বিশেষ নাচের মাধ্যমে সুধা ও পরাগের প্রকৃতি, দূরত্ব ও বিপুল উৎসের খবর মৌচাকে অন্য সদস্যদের জানিয়ে দেয়। সন্ধানীর দেহে লেগে থাকা সুধা ও পরাগ দেখে খাদ্যের ধরণ সম্বন্ধেও মৌমাছিরা অবহিত হয়।

৪। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষা ঃবিবর্তনের গতিপথে মৌমাছিরা অনেক রোগ প্রতিরোধের উপায় করে নিয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে প্রতিরোধের উপায় না থাকলে সামান্য মাত্রায় দমনের ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম । দেহের কাইটিনময় আবরণে আছে অ্যান্টিবায়োটিক গুণসম্পন্ন পদার্থ যা ক্ষতিকর অণুজীবের বৃদ্ধি ও বংশবৃদ্ধি দমন,
এমনকি মেরেও ফেলতে পারে। মৌরুটি,মধু,এমনকি মৌচাকেও আছে অ্যান্টিবায়োটিক পদার্থ। মৌমাছিরা বাসা ও মৌচাকের প্রাচীর প্রোপেলিশ (বা মৌসিরিশ) নামে যে এক ধরনের জৈব রেজিনের প্রলেপ দিয়ে রাখে তাও ক্ষতিকারক অণুউদ্ভিদ-এর বৃদ্ধি প্রতিহত করে। রোগাক্রান্ত বা মৃত লার্ভাকে ঢাকের বাইরে ফেলে দিয়ে মৌমাছিরা সম্ভাব্য সংক্রমণ থেকে কলোনিকে রক্ষা করে । ঋতুভেদে চাকে তাপের তারতম্য ঘটে থাকে । মোমে গঠিত মৌচাক প্রায় তাপ অপরিবাহী হওয়ায় চাকে সব সময় তাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে যা জীবন ধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজন । গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরমে মৌমাছিরা মৌচাকের প্রবেশ মুখে সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ হয়ে সবার মাথা একদিকে রেখে ডানা ঝাঁপিয়ে ভেতরে শীতল বাতাস সঞ্চালিত করে।

৫। প্রতিরক্ষা ঃ মৌমাছি খুবই শান্তিপ্রিয়। অকারণে আক্রমণ করা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ। তবু তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ-মধু অবৈধভাবে সংগ্রহের উদ্দেশে আণুবীক্ষণিক জীব থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত অনেকেই চাকে হানা দেয়। তাদের প্রতিহত করতে প্রকৃতি মৌমাছিকে হুল নামক মারাত্মক বিষাক্ত অস্ত্রে সজ্জিত করেছে। একটি হুলের দংশন যে কোনো পতঙ্গ বা ইঁদুরজাতীয় ক্ষুদ্রদেহী স্তন্যপায়ীর মৃত্যু ঘটাতে যথেষ্ট।

৬। সোয়ার্মিং ও জিনগত উন্নতি সাধন : কলোনি-বিভক্তির মাধ্যমে মৌমাছিদের বংশবৃদ্ধি ঘটে। একটি মৌচাকে কর্মী মৌমাছির সংখ্যাধিক্য ঘটলে স্থানাভাবসহ আরও অনেক কিছুরই অভাব দেখা দেয় । তখন রাণী মৌমাছি কিছু কর্মী মৌমাছির চাপে নতুন আবাস গড়ার উদ্দেশে চাকের প্রায় অর্ধেক কর্মী মৌমাছিসহ ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় । একে সোয়ার্মিং বলে । পরিত্যক্ত চাকে নতুন রাণী পরিস্ফুটিত হয়। নতুন রাণী কয়েকটি পুরুষ অনুগামীসহ নাপসিয়াল উড্ডয়ন-এ পুরুষ (ড্রোন) মৌমাছির পর্যাপ্ত শুক্রাণু সংগ্রহ করে চাকে ফিরে আসে। সংগৃহীত শুক্রাণু দিয়ে রাণী আজীবন যত ডিম পাড়ে তার সবগুলোকেই নিষিক্ত করতে পারে। তাই রাণী জীবনে একবারই মাত্র সঙ্গমে লিপ্ত হয়। ডিম পাড়বার সময় রাণী ইচ্ছানুযায়ী ডিম নিষিক্ত করে । চাকের প্রয়োজনে নিষিক্ত বা অনিষিক্ত ডিম প্রসবিত হয় । অনিষিক্ত ডিম থেকে পুরুষ এবং নিষিক্ত ডিম থেকে কর্মী মৌমাছি বা ভাবী রাণী মৌমাছি সৃষ্টি হয়। এর ফলে একদিকে, কলোনিতে জনবিস্ফোরণ রোধ হয় ও খাদ্য আহরণ ক্ষেত্রের বিস্তার ঘটে, অন্যদিকে ভাবী বংশধরের জিনগত পটভূমিও উন্নত হয়। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ পদ্ধতিতে সম্ভবত মৌমাছিরা সংরক্ষণ ও সাফল্যের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করেছে।

৭। জনগণতান্ত্রিকতা ঃ একটি কলোনিতে রাণীই প্রধানতম ব্যক্তিত্ব । রাণীর উপরই নির্ভর করে একটি চাকের সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ও ক্ষমতা, জীবনের প্রতিটি ছন্দ ও কর্মশক্তি । সমগ্র মৌমাছি গোষ্ঠীকে রাণীই পরিচালিত করে । তাই রাণী মৌমাছিকে একটি জাতির সম্রাজ্ঞী, এমনকি দেবী হিসেবে অভিহিত করা হয়। তা সত্ত্বেও রাণীর অনেক কাজই কলোনির অন্যান্য সদস্যের সিদ্ধান্তে করতে হয় । যেমন- উপযুক্ত সময় এবং মৌমাছিদের সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া রাণী একটি ডিমও পাড়ে না । জন্মগত বিরোধিতার কারণেই রাণী কখনও শূন্য রাণী কুঠুরিতে ডিম পাড়ে না, কিন্তু অন্যেরা তাকে সে কাজেই বাধ্য করে । সোয়ার্মিং এর সময়ও রাণী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বাস্তুত্যাগে উৎসাহী মৌমাছিদের চাপে চাক ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় । রাণী অন্যান্য মৌমাছিদের কাছ থেকে যেমনি শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করে, রাণীও তার বিনিময়ে খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান ও মৌমাছিদের সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে নেতৃত্বে বহাল থাকে অপরদিকে ভবিষ্যৎ সোয়ার্মিং- এ অংশগ্রহণকারীদের চাপে শূন্য রাণী কুঠুরিতে ভাবী রাণী সৃষ্টির উদ্দেশে ডিম পেরে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতেও সাহায্য করে। এ কারণেই মৌমাছির কলোনি একদিকে চিত্তাকর্ষক, অনুসরণীয়, অন্যদিকে, স্বৈরাচারদের জন্য এক ঈর্ষণীয় সমাজবন্ধন ।

৮। উত্তরাধিকার নির্বাচন ঃ মৌচাকে রাণীর মৃত্যু হলে মৌমাছিদের মধ্যে আতংকের ভাব ফুটে উঠে। রাণী ছাড়া মৌমাছিরা বাঁচতে পারে না বলে তারা তিন দিন বয়সের এক বা একাধিক ডিম বেছে নিয়ে সুপ্রশস্ত খোপে রেখে দেয়। রাণী হিসেবে নির্বাচিত লার্ভাকে বিশেষভাবে প্রস্তুত রাজসিক জেলি খাওয়ানো হয় বলে সেটি রাণী মৌমাছিরূপে বেড়ে উঠে। এভাবে ষোল দিনের মধ্যে মৌমাছিরা নতুন রাণীকে পূর্ণাঙ্গ করে তোলে ।

৯। রাণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঃ অনুচর কর্মী মৌমাছিরা রাণীর পরিচর্যা করে। রাণীর দেহ পরিস্কার করা, শরীর
আঁচড়ান, মৌচাক থেকে মল অপসারণ ও পুষ্টিকর রাজসিক জেলি খাওয়ানো তাদের কাজ। রাণী মৌচাকের যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে আজীবন এক অটুট সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। তাবলে রাণীর জুলুম-নির্যাতন ওরা মুখ বুজে সহ্য করে না, বরং আক্রমণাত্মক বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাণী-মৌমাছিকে হয় তাড়িয়ে দেয় নয়তো মেরে ফেলে । এভাবে একেকটি চাকের মৌ-সমাজ টিকে থাকে ।

১০। চুরি-ডাকাতি ঃ একটি জাতি যখন অসতর্ক ও বিশৃঙ্খল থাকে, সে সুযোগে বহিঃশত্রু কীভাবে অনধিকার প্রবেশ ঘটিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয় তাও মৌমাছি-কলোনির অবস্থা দেখে অনুমান করা যায়। যে কোনো তুচ্ছ ব্যাঘাতের কারণে কলোনি-জীবনের ঐকতান ছিন্ন হয়ে যায়, চাকে ও মাঠে কাজের ছন্দপতন ঘটে । তখন খোলা চাক থেকে মধুর কড়া গন্ধ ছড়াতে থাকে । মৌমাছিরা শত শত মিটার দূর থেকে এ গন্ধ পায় । খোলা চাকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মধুর গন্ধে বিমোহিত হয়ে অন্য চাকের মৌমাছিরা দ্রুত যাত্রাপথের পরিবর্তন ঘটিয়ে রক্ষীবিহীন, অরক্ষিত প্রবেশ পথের ভেতর দিয়ে চাকে প্রবেশ করে, এবং আকুন্ঠ মধু পান করে লুণ্ঠিত দ্রব্যসহ চাকে ফিরে যায় । ফেরার আগে অঞ্চলটি চিনে রাখার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে। এখানে একটি খোলা চাক আছে এমন সংকেতও দিয়ে যায় যাতে অন্যরা মধু লুট করতে পারে ।

মৌমাছির সামাজিক জীবনযাত্রা এমনই চিত্তকর্ষক, তাদের আচরণ ও কাজের বৈচিত্র্য এমন বিষ্ময়কর যা দেখলে মনে হবে মানুষের মতো মৌমাছিরও হয়তো আবেগ, আনন্দ, দুঃখ, ভালোবাসা আছে, আছে আত্মত্যাগের মনোভাব । মৌমাছির সামাজিক জীবন এভাবে মানুষকে লক্ষ বছর ধরে ভাবিত করে রেখেছে, এখনও অনুপ্রাণিত করে চলেছে। 

ReplyForwardAdd reaction


About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

two × one =