রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে সামাজিক চুক্তি মতবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মতবাদ। দার্শনিক হবস, লক ও রুশো সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা।
সামাজিক চুক্তি মতবাদ : সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় চুক্তির মাধ্যমে। এ মতবাদ
অনুযায়ী অতীতে এমন একদিন ছিল যখন রাষ্ট্র বলে কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। মানুষ তখন ‘প্রকৃতির রাজ্যে বাস করতো। প্রাকৃতিক অবস্থায় কোন শাসন বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কালক্রমে এ অবস্থায় নানারূপ বিঘ্ন উপস্থিত হয় মানুষ ভয়ানক অসুবিধায় পতিত হয়। এসব অসুবিধা দূর করার জন্য তারা চুক্তি করে এবং সংঘবদ্ধ জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র সংগঠন। সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূলকথা প্রধানত দু’টি। যথা : (ক) রাষ্ট্র জনগণের চুক্তির ফলশ্রুতি এবং (খ) শাসকগণ তাদের কার্যক্রম ও নীতির জন্য জনগণের নিকট দায়ী।
প্রাচীন দার্শনিকদের লেখায় এ মতবাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসে সোফিস্ট গোষ্ঠীভু বলতেন, রাষ্ট্র চুক্তির ফলস্বরূপ। প্লেটোর গুরু দার্শনিক সক্রেটিসকে যখন তাঁর শিষ্যগণ কারাগার থেকে পলায়নের উপদেশ দিয়েছিলেন তখন তিনি বলেছেন, “আমি কারাগার থেকে পলায়ন করে রাষ্ট্রের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করতে পারি না।”
প্লেটো এবং এরিস্টটলের লেখাতেও সামাজিক চুক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্রের ভিত্তিমূলও
তাছাড়া মধ্যযুগের শেষ পর্বে শাসকদের অত্যাচার থেকে অব্যাহতি লাভ করার জন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রবক্তাগণ চুক্তিবাদের দোহাই দিয়ে রাজার শাসনকে চুক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, মেনগোল্ডের কথায়, “প্রজারা রাজাকে অপসারণ করতে পারে, কেননা রাজার শাসন প্রজাদের চুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।” এ মতবাদের সুষ্ঠু আলোচনা ও জোরালো সমর্থন পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের সতেরো শতকের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবসের (Hobbes) বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Leviathan’, খ্যাতনামা লেখক ও দার্শনিক জন লকের (John Locke) প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘Two Treatises of Civil Government’ এবং আঠারো শতকের ফরাসি চিন্তাবিদ রুশোর (Rousseau) ‘ The Social Contract’ গ্রন্থে।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের গুরুত্ব : সামাজিক চুক্তি মতবাদটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হলেও এর গুরুত্ব
অনেক বেশি। এ মতবাদের গুরুত্ব নিম্নে আলোচিত হলো :
১. গণতান্ত্রিক : সামাজিক চুক্তি মতবাদ গণতান্ত্রিক। এ মতবাদে ব্যক্তির অবাধ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা ব্যক্ত
করে সামাজিক চুক্তি মতবাদ গণতন্ত্রের পথ প্রস্তুত করেছে।
২. স্বৈরাচারী শাসনের পতন : সামাজিক চুক্তি ঐশ্বরিক ও বলপ্রয়োগ মতবাদে যে ভয়াবহ পরিণতি তা থেকে বিশ্বকে
উদ্ধার করেছে । এ মতবাদে স্বৈরাচারী শাসনের পতনের মাধ্যমে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণের আছে।
৩. যুক্তির প্রয়োগ : এ মতবাদে যুক্তির উপর প্রাধান্য বিস্তার করা হয়। ন্যায়নীতি এ মতবাদের মাধ্যমে দেখা যায়।দেখা যায়।
8. রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য : সামাজিক চুক্তি মতবাদের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে বর্তমানে যে পার্থক্য তা
৫. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ : এ মতবাদের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবর্তন হয়। মানুষ বাঁচার জন্য এবং স্বাধীনতা অধিকার সংরক্ষণের জন্যই চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করেছে।
৬. সার্বভৌমত্বের বিকাশ : রাষ্ট্রের অন্যতম হলো সার্বভৌমত্ব। আর সামাজিক চুক্তি মতবাদের মাধ্যমে আমরা সার্বভৌমত্বের বিকাশ সম্পর্কে ধারণা পাই। হবসের রচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে অস্টিন আইনগত সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা
প্রদান করেছেন। বর্তমানে যাকে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বলা হয় তার স্রষ্টা ছিলেন জন লক। আর জনগণের সার্বভৌমত্বের জোর প্রবক্তা ছিলেন রুশো। সম্পত্তির উপাদান কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক চুক্তি মতবাদটি একেবারে মূল্যহীন নয়। আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে সামাজিক চুক্তি মতবাদের উপর ভিত্তি করে। জন লক ও রুশো উভয়ই বলেছেন, “মানুষ নিজেই তাদের রাজনৈতিক ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক। তাদের জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার ও সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণের জন্যই মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করেছিল।”
সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচনা : নিম্নে এ মতবাদের সমালোচনা উল্লেখ করা হলো : সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।সামাজিক চুক্তি মতবাদ ক্ষণস্থায়ী। অতীতে চুক্তি সম্পাদনের ভিত্তিতে যারা রাষ্ট্র গঠন করেছিল তাদের তিরোধানের সাথে রাষ্ট্রেরও বিলুপ্তি ঘটেছিল ।
iii. প্রাকৃতিক পরিবেশে জনগণের মধ্যে চুক্তি দ্বারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা কল্পনাপ্রসূত, বাস্তব নয় ।
iv. আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্ববিদগণ গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন, মানুষ কোনদিন রাজনৈতিক সমাজ ছাড়া বাস করত না।
পরিশেষে বলা যায় যে, মালোচনা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যুক্তি মতবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিক প্রাধান্য যুক্ত মতবাদ এবং সামাজিক চুক্তি মতবাদ বহুল আলোচিত একটি মতবাদ।