ভূমিকা : যেকোনো কাজই হলো পরিশ্রম। আমরা যখন জমি চাষ করি, কিংবা বোঝা বহন করি, তখন আমরা হাত দিয়ে কাজ করি— একে বলে কায়িক শ্রম। আমরা যখন বই পড়ি বা বই লিখি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক প্রধান ভূমিকা পালন করে— একে বলে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক শ্রম। জীবনের প্রতিটি স্তরে উভয় শ্রমের গুরুত্ব আছে। তবে শ্রম বলতে সাধারণত কায়িক শ্রমকেই বুঝানো হয় এবং কায়িক শ্রমের মর্যাদাকেই মূলত শ্রমের মর্যাদা বলা হয়। পরিশ্রম ব্যতিরেকে কিছুই অর্জন করা যায় না।
শ্রমের গুরুত্ব : কায়িক শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। একে বাদ দিয়ে মানবজীবনে দৈনন্দিন কাজকর্ম চলে না। কৃষক জমি চাষ করার মাধ্যমে আমাদের খাদ্য সরবরাহ করে; রাজমিস্ত্রি বাড়ি নির্মাণ করে; ছুতোর আসবাবপত্র তৈরি করে এবং কামার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করে নানা সামগ্রী। কায়িক শ্রমের গুরুত্ব বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের গুরুত্বের চেয়ে কম নয়। লেখক যিনি পুস্তক রচনা করেন, অফিসার যিনি অফিসে কাজ করেন কিংবা বিজ্ঞানী যিনি প্রকৃতির গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনে গবেষণা করেন, তাঁরা সবাই প্রয়োজনীয় কাজ করেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সারা পৃথিবীতে কৃষক যদি তার কাজ বন্ধ করে দেয়, কামার, কুমার, ছুতোর সবাই যদি নিজ নিজ কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়, তখন কী পরিণতি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। তখন জগৎসুদ্ধ লেখক, বিজ্ঞানী, অফিসার সকলেই না খেয়ে মরতে বসবে। জীবনের জন্য শ্রমের প্রয়োজন আছে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। শ্রমের প্রতি অবহেলা : আমাদের দেশে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় ও বিত্তবানেরা কায়িক শ্রমকে ঘৃণা করে। সামান্য একটি বোঝা বহন করাকে তারা সম্মানের হানিকর মনে করে। সম্মান বা মর্যাদা সম্পর্কে একটি মিথ্যে ধারণা এই হীনতার পেছনে সক্রিয়। কায়িক শ্রমে অমর্যাদাকর কিছু নেই। বরং শ্রমের প্রতি অনুরাগ চরিত্রের স্বাধীনতা ও কাজের অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে। হাঁটার শক্তি থাকা সত্ত্বেও গাড়ি ডাকা কিংবা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও একটি হালকা বোঝা বহন করার জন্য কুলি খোঁজা পরনির্ভরশীলতার পরিচায়ক; এটি পৌরুষের পরিপন্থী, তাই ঘৃণার যোগ্য। অনেক শিক্ষিত, বিত্তবান তথাকথিত ভদ্রলোক আছে যারা শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে যাবতীয় সংসব এড়িয়ে চলে। অন্যের দ্বারা কাজ করিয়ে নেয়ার ক্ষমতাকে তারা ভদ্রলোকের অধিকার বলে গণ্য করে। আসলে সামান্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই শ্রমকে অমর্যাদাকর মনে করে। অনেকেই মনে করে, ছোট কাজ করা মানে নিজেকে ছোট করা। শ্রম সম্পর্কে এরূপ ধারণা মোটেই সত্যি নয়। কোনো শ্রমই মানুষকে ছোট করে না, বরং শ্রম মানুষের মহিমা বর্ধিত করে, তাকে গৌরবান্বিত করে।
ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে শ্রম : মানুষের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে শ্রমের প্রয়োজন আছে। শ্রম বিনা আমাদের খাওয়া-পরা চলবে না। সকল শ্রমের মর্যাদা সমান। সমাজে শিক্ষক, ডাক্তার বা আইনজীবীর যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি সমান প্রয়োজন আছে কৃষকের, জেলের কিংবা কামার-কুমারের। ক্ষুদ্র পেশা, নগণ্য জীবিকা ও মোটা পোশাকের জন্য কাউকে ঘৃণা করা উচিত নয়। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা জাতিগত সকল উন্নতির মূলেই রয়েছে কঠোর পরিশ্রম। আজকাল আমাদের দেশে বহু শিক্ষিত যুবক কর্মের অভাবে বেকার বসে আছে। তারা কায়িক শ্রমকে হীন বিবেচনা করে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি করে চলেছে। কিন্তু কায়িক শ্রমে কোনো হীনতা নেই। কায়িক শ্রম অতি মহৎ। এতে ধন উৎপাদন হয়, যার ফলে দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি ও কল্যাণ নিশ্চিত হয়।
সমাজে শ্রমিকের অবস্থান : শ্রমিকের ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে সমাজের উন্নতি সাধিত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কর্মী কাজ করে, কিন্তু ফল ভোগ করে অন্যজন। চাষি চাষ করে, কিন্তু ফসল ভোগ করে জমির মালিক। দরিদ্র পরিদ্রই থাকে, বিত্তবান হয় অধিকতর বিত্তবান। শ্রমিকের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না; তাকে সব সময় কাজ করেই বেঁচে থাকতে হয়। এভাবেই জন্মলাভ করেছে সামাজিক অসাম্য। কৃষক-শ্রমিক যারা কায়িক শ্রম করে, তারা পড়ে থাকে সমাজের নিচের তলায়; দারিদ্র্য, দুঃখ-শোক, অন্ন-বস্তু-শিক্ষার অভাব তাদেরকে গ্রাস করে রাখে। এ সকল শ্রমজীবী ব্যক্তির কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই। যে শ্রমিক আমাদের জীবনে সুখ নিশ্চিত করতে পারে, যে কৃষক আমাদের অন্ন যোগায়, সমাজে তারা অবজ্ঞার পাত্র।
শ্রমের উপকারিতা : কায়িক শ্রম বহু দিক দিয়ে আমাদের জন্য উপকারী। এ শ্রম আমাদেরকে শারীরিকভাবে সুস্থ রাখে এবং নৈতিক উন্নতি লাভের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। একটি দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য কায়িক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মুটে, মজুর, ছুতোর, রাজমিস্ত্রি, কামার, কৃষক প্রমুখ কর্মজীবীই একটি জাতির মেরুদণ্ড। তাদের শ্রমকে অবজ্ঞা করা মিথ্যে অহংকার মাত্র। শ্রম শুধু সমৃদ্ধিই দেয় না, শ্রম সৃষ্টির আনন্দও প্রদান করে। প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রতিভা বিকাশেও শ্রমের ভূমিকা অপরিহার্য। কথায় বলে “Man is the architect of his own fate”-মানুষই তার নিজের ভাগ্যের কৃপতি। শ্রম দিয়েই মানুষ তার ভাগ্যকে নির্মাণ করে। শ্রমই তার ভাগ্য পরিবর্তনের প্রকৃত হাতিয়ার। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা। পরিশ্রম সে প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে, বিকশিত করে। পরিশ্রম মানুষকে সুন্দর করে, সার্থক করে।
সভ্যতার বিকাশে শ্রমের অবদান : সভ্যতার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশে শ্রমের অবদান অপরিসীম। লক্ষ শ্রমিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাত দিয়েই অতীতে নির্মিত হয়েছে বহু শিল্প ও স্থাপত্য। ময়নামতি, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, সোনারগাঁও, বাগেরহাট ও ঢাকার প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ তার পরিচয় বহন করে। বিশ্ববিখ্যাত তাজমহল, কুতুবমিনার, আইফেল টাওয়ার ইত্যাদি অসংখ্য শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রমের ফসল। মানবসভ্যতার ভিত্তি রচিত হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির নিরলস শ্রমের কল্যাণে। একদিন মানুষ পাথরের নুড়ি দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করতে শিখেছিল। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে কালক্রমে মানুষ সৃষ্টি করেছে দালান-ইমারত, কল-কারখানা ও সড়ক-জনপথ। শ্রমজীবী মানুষই নতুন নতুন রাজ্যের আবাদ করেছে, নতুন নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এরা প্রকৃতিকে বশীভূত করেছে; মাটি খুঁড়ে, পাথর কেটে তৈরি করেছে রাজপথ; নদীর বুকে নির্মাণ করেছে সেতুর বন্ধন। এরাই শক্তি দিয়ে, শ্রম দিয়ে মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে এক সভ্যতা থেকে আর এক সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে। শ্রমের সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতার সম্পর্ক অতি নিবিড়।
উন্নত দেশে শ্রমের অবস্থা : পাশ্চাত্যের উন্নত দেশে কায়িক শ্রমকে কেউ ঘৃণার চোখে দেখে না। এসব দেশে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও ছুটির সময় বিভিন্ন হোটেল বা অন্যান্য স্থানে চাকর-চাকরানীর মতো কাজ করে খরচের টাকা রোজগার করে থাকে। এসব দেশে বহু ঝাড়ুদার, দিনমজুর বা রাজমিস্ত্রিরও নিজস্ব গাড়ি আছে। সেখানে একজন অফিসার ও একজন দিনমজুরের পারিশ্রমিকের মধ্যে বিরাট ব্যবধান নেই। যেকোনো শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন সরকার কর্তৃক এম নভাবে। নির্ধারিত করা থাকে যাতে তারা জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারে। এ দেশে শ্রমের মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কাজের জন্য যথাযথ পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে। উন্নত মানুষ মাত্রই পরিশ্রমী মানুষ। কোনো কাজকেই তারা ছোট মনে করে না। প্রাচীন গ্রিস, রোম, চীন ও ভারত যেমন, আধুনিক রাশিয়া, আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জাপান ও জার্মানিও তেমনি তাদের জনগণের নিরলস পরিশ্রমের অবদান।
পরিশ্রমী মহাপুরুষদের দৃষ্টান্ত : মহাপুরুষেরা শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মহান বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটি গল্প আ মরা সবাই জানি। একদিন মূল্যবান পোশাক-পরিহিত এক তরুণ গ্রামের এক স্টেশনে কোনো কুলি না পেয়ে মোটা কাপড়-পা এক ব্রাহ্মণকে তার বাক্সটি টাকার বিনিময়ে বহন করার প্রস্তাব দেয়। তাঁরা উভয়ে গন্তব্যে পৌঁছার পর তরুণ লোকটি ব্রাহ্মণকে মঙ চুরি দিতে চাইলে ব্রাহ্মণ নিজেকে বিদ্যাসাগর বলে পরিচয় দেন এবং মজুরি নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তরুণটি এতে যে শিক্ষা লাভ করেন, তা তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। আব্রাহাম লিঙ্কন শ্রমের মর্যাদা স্বীকার করতেন। জীবনে অতি ছোট অবস্থান থেকে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন।
উপসংহার : পৃথিবীতে যত কীর্তি স্থাপিত হয়েছে, তাদের মূলে রয়েছে মানুষের পরিশ্রম। এই শ্রমের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে বলে পাশ্চাত্য দেশসমূহ এত দ্রুত উন্নতিসাধন করেছে। পরিশ্রমকে অবজ্ঞা করে কোনো জাতিই উন্নতি করতে পারে না। সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পরিশ্রমসহকারে পালন করলেই সমাজের সমৃদ্ধি আসে। সমাজের অগ্রগতি ত সামাজিক মানুষের শ্রমের উপরই নির্ভরশীল। এই শ্রম মানুষকে অমরত্ব দান করে। শ্রমের মর্যাদা অতীতেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ব্যক্তিজীবনে হোক, কিংবা সমাজ জীবনেই হোক—সমৃদ্ধি ও উন্নতির প্রত্যাশা করলে পরিশ্রমের। কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদেরকে পরিশ্রমী হতে হবে এবং পরিশ্রমের মাধ্যমেই দেশ ও জাতির গৌরব বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে।