ভূমিকা : দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সংবাদ প্রকাশিত হয় যেসব পত্র-পত্রিকায়, তাদের নাম সংবাদপত্র। মানুষের জানার আগ্রহ থেকে এর উৎপত্তি। বিশাল পৃথিবীতে মানুষ তার চারপাশে কী ঘটছে, তা জানতে চায়। তার এ কৌতূহল নিবৃত্ত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম সংবাদপত্র। সংবাদপত্র বর্তমান বিশ্বে সভ্য জাতির জীবনে এক অপরিহার্য উপকরণ। বর্তমান ইতিহাসের সারাংশই এতে বিধৃত হয়। আধুনিক সভ্য মানুষ সংবাদপত্র ছাড়া একদিনও চলতে পারে না। সভ্য সমাজের কর্ম ও চিন্তাধারাকে পরিশীলিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে সংবদপত্র।
সংবাদপত্রের উৎপত্তির ইতিহাস : সংবাদপত্রের প্রচলন কখন, কোন দেশে প্রথম শুরু হয়, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে অনেকেই মনে করেন সংবাদপত্রের প্রথম প্রচলন হয় চীন দেশেই। ইউরোপের ভেনিসে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। পরে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে সংবাদপত্র প্রকাশ পায়। রানি এলিজাবেথের সময়ে ইংলন্ডে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রের প্রচলন হয় বলে শোনা যায়। পাক-ভারতে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে রাজকর্মচারীদের মধ্যে এক প্রকার হাতে-লেখা সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল। এর প্রচার ছিল খুব সীমিত। ভারতে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ প্রকাশিত হয় ১৭৪৪ সালে। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হয় উভয় বাংলার প্রথম সবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’। শ্রীরামপুর খ্রিস্টান মিশনারিগণ কর্তৃক প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ ১৮১৮ সালে। বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র হচ্ছে ‘আজাদ।”
প্রকারভেদ : সংবাদপত্র নানা প্রকারের হয়। যেমন—দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বার্ষিক ইত্যাদি। তবে সংবাদপত্র বলতে সাধারণত দৈনিক পত্রিকাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। অন্যগুলোকে বলা হয় সাময়িকপত্র। এগুলোতে গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা ও সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়। দৈনিক পত্রিকায় দেশ-বিদেশের প্রতিদিনের নানা টাটকা খবর থাকে। তার মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিবিধ সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান (সংবাদ সংগ্রহ) : সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কতকগুলো সংবাদ প্রতিষ্ঠান আছে। এপিপি, ইউপিপি, এপিআই, ইউএনআই, রয়টার, তাস, ইরনা, এনা প্রভৃতি এরূপ কতিপয় সংবাদ প্রতিষ্ঠান। সংবাদপত্রে যে প্রাত্যহিক বিশ্বের যাবতীয় সংবাদ প্রকাশিত হয়, তা সম্ভব হয় মূলত এ সকল সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই। ‘রয়টার’ নামক সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর সর্বত্র শাখা বিস্তার করেছে। এ সকল প্রতিষ্ঠান
থেকে সংবাদ ক্রয় করে তা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থার নাম বাসস। বর্তমানে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে টেলিফোন, ফ্যাক্স, কম্পিউটার, ইন্টারনেট-এর বদৌলতে সংবাদ সংগ্রহ করা সহজতর হয়েছে। প্রত্যেক সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা থাকে। তারা তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকার সংবাদ সংগ্রহ করে প্রধান কার্যলয়ে প্রেরণ করে। এভাবে একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতির মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ ও সংবাদ সরবরাহ করার কাজ সম্পন্ন হয়।
সংবাদপত্র পাঠের প্রয়োজনীয়তা : বর্তমান বিশ্বে সংবাদপত্র বহু কল্যাণকর ভূমিকা পালন করে। সংবাদ সরবরাহ করা সংবাদপত্রের প্রধান লক্ষ্য হলেও আধুনিক সংবাদপত্রের পরিধি অনেক ব্যাপক। সংবাদপত্র সভ্য সমাজের নানা প্রয়োজন মেটায়। মতামত প্রকাশ, জনমত সংগঠন, শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে লোকশিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতগুলো মাধ্যম আবিষ্কৃত হয়েছে, তাদের মধ্যে সংবাদপত্রের আসন সর্বশ্রেষ্ঠ। গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ছাড়াও সংবাদপত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে নানা আলোচনা ও নিবন্ধ থাকে। তাছাড়া ক্রীড়া জগৎ, মঞ্চ, সিনেমা, স্টক, শেয়ার বাজার প্রভৃতি বিষয়ও এর অন্তর্গত। তাই সংবাদপত্রকে বহুমুখী জ্ঞান অর্জনের সহায়ক একটি মূল্যবান উপকরণ বলা যায়। সংবাদপত্রের শিক্ষা পুস্তকের শিক্ষাকে পরিপূরণ করে। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম সংবাদপত্র। রাষ্ট্রের বিধি ব্যবস্থা প্রচার ও জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সংবাদপত্র সেতুবন্ধ রচনা করে। সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনের একটি শ্রেষ্ঠ বাহন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা, ভোক্তা- উৎপাদনকারী এবং লেখক-পাঠকের মধ্যে একটি কার্যকর যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সংবাদপত্রের বিনোদনমূলক গুরুত্বও কম নয়। এটি দৈনন্দিন বিনোদনেরও মাধ্যম। সংবাদপত্র একাধারে একটি গ্রন্থ, একটি ধর্মপ্রচারবেদী, একটি রাজনৈতিক মঞ্চ, একটি ব্যবসা কেন্দ্র— এককথায়, একের মধ্যে বহুর অন্য নাম সংবাদপত্র। সংবাদপত্রের বহুবিধ গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে কোনো কোনো মনীষী এর নাম দিয়েছেন “জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়।”
সংবাদপত্রের প্রভাব : সমাজ ও জনগণের উপর সংবাদপত্রের একটি বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাব যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিতকর, কখনো কখনো এটি অহিতকরও হতে পারে। বেশিরভাগ পত্রিকাই যেহেতু দলীয় পত্রিকা, তাই প্রত্যেকটি পত্রিকা স্বাভাবিকভাবে নিজ রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুগত থাকে। সংবাদপত্র জনমনের উপর প্রভাবের সুযোগ নিতে পারে এবং তাদেরকে ক্ষতিকর কাজে প্ররোচিত করতে পারে। সংবাদপত্র সমগ্র জাতিকে নিজেদের ভাগ্য গঠনে যেমন অনুপ্রাণিত করতে পারে, তেমনি দেশের মানুষকে একটি পর্যায় পর্যন্ত বিপথেও পরিচালিত করতে পারে। এটি শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব ও সাম্প্রদায়িক সমস্যার জন্ম দিতে পারে। কখনো কখনো মিথ্যা, বানোয়াট, অতিরঞ্জিত ও উত্তেজক সংবাদ পরিবেশন করে, সংবাদপত্র ব্যক্তিতে- ব্যক্তিতে ও জাতিতে–জাতিতে ভুল বোঝাবুঝি ও তিক্ততার সৃষ্টি করতে পারে।
উপসংহার : সংবাদপত্রের কতিপয় দুর্বল দিক থাকলেও এর অপরিসীম গুরুত্বের কথা অস্বীকার করা যাবে না। একে যখন দলগত ও সম্প্রদায়গত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়, তখনই জনগণ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়। এরূপ সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির জন্য বিপজ্জনক, এটা পরিহার করা উচিত। সংবাদপত্রকে এরূপে ব্যবহার করা দরকার যাতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি ব্যক্তি নিজের নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্বদেশপ্রেম ও মানবকল্যাণের আদর্শকে সমুন্নত রাখাই সৎ সাংবাদিকতার মূল কথা।