ভূমিকা : সত্যবাদিতা মানব চরিত্রের একটি মহৎ গুণ। কোনো কিছু গোপন না করে অকপটে সত্য প্রকাশ করার নাম সত্যবাদিতা। যেমন জেনেছি, যা দেখেছি, যা শুনেছি, ঠিক তেমন করে বলাই সত্য বলা। কোনো বিষয় বা ঘটনা বিকৃত না করে যথার্থ ও সঠিকভাবে প্রকাশ করাকে সত্যবাদিতা বলে। এটি চরিত্রের অমূল্য ভূষণ; এ গুণ মানবচরিত্রকে গৌরবান্বিত করে তোলে। সত্যবাদিতা আক্ষরিক অর্থে যদিও সত্য কথা বলা, কিন্তু প্রকৃত অর্থে সত্য কথা বলা, সত্য গোপন না করা, মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া ইত্যাদিকে একসঙ্গে সত্যবাদিতা বলা হয়। মিথ্যাকে পরাভূত করে সত্য চিরদিন মাথা উঁচু করে থাকে। তাই সত্যের মর্যাদা ও গৌরব অপরিসীম।
সত্যবাদিতার বৈশিষ্ট্য : মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলির মধ্যে সত্যবাদিতা শ্রেষ্ঠ। কোনো কিছুর যথাযথ ও অবিকৃত প্রকাশই সত্য। সত্যকে ভিত্তি করে সত্যবাদিতা বিকশিত হয়। সত্যবাদীর কাজের মধ্যে কোনো কপটতা নেই, কোনো কৃত্রিম ভান নেই। সত্যের দ্বারা মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বা অবস্থা জানা যায়। সত্যবাদী কখনো অসৎ কাজে লিপ্ত হতে পারে না। সত্যবাদীর স্থান সবার ওপরে— তার মর্যাদা সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। সত্যবাদীকে সমাজে সবাই শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। সত্যবাদী হতে হলে সব সময় সত্য বলার অভ্যাস করতে হয়। সত্যবাদিতা অটুট রাখতে গেলে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। সত্যবাদী সেই বিপদে ভীত হয় না; দৃঢ় মনোবল নিয়ে সে বিপদের মোকাবিলা করে।
সত্যবাদিতার সুফল : সত্যবাদিতা মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। সত্যবাদিতা মানুষের জীবনকে সার্থক ও বিশিষ্ট করে তোলে। সত্যকে অবলম্বন করলে জীবনে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। মানুষের নৈতিক জীবনে সত্যের মূল্য অনেক বেশি। সত্যবাদীকে সবাই বিশ্বাস করে। সত্যবাদীর মনে সৎসাহস থাকে। সত্য সম্পাদন করতে সে কাউকে ভয় করে না; লোকের নিন্দা, গ্লানি, পরিহাস ইত্যাদিতে সে বিচলিত হয় না। সত্যে বিশ্বাসীরা ধৈর্যের সঙ্গে সত্যের অনুসরণ করে; সত্য তাদের জীবনে সাফল্য এনে দেয়। সত্যবাদী ব্যক্তি তার কথায়, কাজে ও চিন্তায় সব সময় সত্যের অনুসারী। সত্যবাদিতাই যথার্থ কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। প্রকৃত সত্য মিথ্যাকে অপসারণ করেও গৌরবের সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। একজন দরিদ্র-নিরক্ষর সত্যবাদী মানুষ বিত্তবান পণ্ডিত মিথ্যাবাদীর চেয়ে উত্তম। সত্যের কোনো পরাজয় নেই; সত্য মানুষের জীবনকে সুন্দর করে, মহীয়ান করে। সত্যবাদী ব্যক্তি সমাজের কাছে আদর্শ হয়ে থাকে।

মিথ্যার কুফল : মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না, শ্রদ্ধা করে না। মিথ্যাবাদী সমাজে ঘৃণার পাত্র। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কেউ পৃথিবীতে উন্নতি লাভ করতে পারেনি। মিথ্যাবাদী কখনো বুক ফুলিয়ে কিছু করতে বা বলতে পারে না। সে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, কখন তার মিথ্যা প্রকাশ পেয়ে যাবে। মিথ্যাচার মানুষকে দুর্বল ও ভীরু করে রাখে। স্বার্থান্ধ মানুষ অনেক সময় তার স্বার্থ হাসিলের জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়। মিথ্যার ছলনায় স্বার্থ উদ্ধার করে। মিথ্যা সাময়িকভাবে জয়লাভ করলেও তা কখনো স্থায়ী হয় না। একসময় মিথ্যা ধরা পড়ে যায়, সত্যের জয় হয়। মিথ্যাবাদীর মনে কোনো শান্তি থাকে না; তার মনে সব সময় একটি অপরাধবোধ ক্রিয়াশীল থাকে। মিথ্যাবাদী ব্যক্তি ধনী বা প্রতাপশালী হলে তার সামনে মুখের ওপর কেউ কিছু বলতে পারে না। কিন্তু তাকে সবাই অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। সমাজে সে অত্যন্ত ঘৃণিত। তার মধ্যে সব সময় অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার ভয় থাকে। মিথ্যাবাদিতা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। মিথ্যা কোনো-না-কোনো সময় প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে। মিথ্যাবাদীর তখন আর লুকাবার পথ থাকে না। মিথ্যা মানুষকে নরকের পথে ঠেলে দেয়। মিথ্যার অনুসারীরা ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করে থাকে। মিথ্যা পরিহার করে সত্যকে আঁকড়ে ধরা বুদ্ধিমানের কাজ।
সত্যবাদিতার দৃষ্টান্ত : মহাপুরুষেরা সত্যকে অবলম্বন করে তাঁদের জীবনের মহৎ সাধনায় সাফল্য লাভ করেছেন। সত্যবাদিতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাঁরা শত্রুকে পরাজিত করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সত্যের সাধনায় মহাপুরুষগণ পৃথিবীতে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা যুগ যুগ ধরে মানবজাতিকে অনুপ্রেরণা দিতে থাকবে। জগতে অমর ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করলে তাঁদের সত্যবাদিতার কাহিনি আমরা জানতে পারি। ইসলাম ধর্মের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) ছিলেন সত্যবাদিতার অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর অতুলনীয় সত্যবাদিতার জন্য দেশবাসী তাঁকে ‘আল-আমিন’ বা ‘পরম সত্যবাদী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সারাজীবন তিনি মাথা উঁচু করে সত্যের আদর্শ প্রচার করে গেছেন। সত্যবাদিতার জন্য তাঁকে তাঁর শত্রুরাও সম্মান করতেন।
উপসংহার : সত্যবাদিতা মানুষকে মহান করে, উদার করে। যুগে যুগে মহামানবেরা সত্যের সাধনা করে গেছেন। জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করার লক্ষ্যে ছোটকাল থেকে সত্য বলার অভ্যাস করা উচিত। জীবনে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। সত্যের পথেই জীবনের সার্থকতা— এ কথা স্মরণ রেখে সত্যবাদিতার চর্চা করা সকলেরই উচিত।