রাষ্ট্র গঠনের চারটি উপাদানের মধ্যে সার্বভৌমত্ব অন্যতম।সার্বভৌমত্ব ধারণাটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি।সার্বভৌমত্ব ছাড়া কনো রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। সার্বভৌমত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ”Sovereignty”’Sovereignty’ যা ল্যাটিন শব্দ Superanvs এবং ‘Sovrano’ থেকে এসেছে।এ দুটি ল্যাটিন শব্দের অর্থ হলো ‘Supreme”Supreme’ অর্থাৎ প্রধান বা চূড়ান্ত।সুতরাং বুৎপত্তিগত অর্থে সার্বভৌমিকতা বলতে এক বিশেষ ক্ষমতাকে বোঝায়।
বিভিন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সার্বভৌমত্বের সংঙ্গা দিয়েছেন।যেমন-মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অর্ধাপক বার্জেস (Prof.Burgess) এর মতে,সার্বভৌমিকতা হলো সকল প্রজা ও তাদের সকল সংগঠনের উপর আদি, নিরঙ্কুশ ও সীমাহীন ক্ষমতা।”
ব্লাকষ্টোন(Blackstone) এর মতে,”সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের চরম, অপ্রতিরোধ্য, শর্তহীন কর্তৃত্ব।” (The supreme,irresistible,absolute,uncontrollwd authority.)
উইলোবি( Willoughby) ভাষায়,”সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা।”
Anderson and Christol বলেছেন, “The world Sovereignty denotes supreme and final legal authority above beyond which no further legal power exists.”
সার্বভৌমত্বের একাত্ববাদ কি ও সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ বলতে কি বুঝ
জন বডিন,টমাস হবস,জেরেমি বেন্থাম প্রমুখ দার্শনিক সার্বভৌমত্বের যে সব মতবাদ প্রচার করেছেন তাকে সার্বভৌমত্বের একত্ববাদী তত্ত্ব বলা হয়ে থাকে। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে একত্ববাদ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :
জন বডিন:ফরাসি চিন্তানায়ক জন বডিন বলেন, সার্বভৌমিকতা হলো আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত এবং চরম ও চিরস্থায়ী ক্ষমতা। আইনের উৎস হিসেবে তিনি সার্বভৌম কর্তৃত্বের কথা বলেছেন।
টমাস হবস:টমাস হবস,তঁার ‘Leviathan’গ্রন্থে সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করেন। হবসের মতে,প্রাকৃতিক পরিবেশের দুর্বিষহ ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে।এ পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে আদিম মানুষ সকলে নিজেদের সকল ক্ষমতা কোন বিশেষ ব্যক্তির হাতে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ করল।এভাবে সকল ক্ষমতা সমর্থন করায় এক সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি হলো।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট যে, সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত একত্ববাদ বলতে আইনসংগত মতবাদকে বুঝায়। একত্ববাদ এর মূল কথা হলো যে, সার্বভৌমিকতা চরম, অবাধ ও অসীম।সার্বভৌমিকতা এক ও অবিভাজ্য।
আইনগত সার্বভৌমিক কি ও বলতে কী বুঝ?
সার্বভৌমত্বের আলোচনায় দুটি বিষয় চলে আসে। যথা:১.আইনগত সার্বভৌমত্ব,২.রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব । রাষ্ট্রের মধ্যে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রের চরম আজ্ঞাকে আইন হিসেবে ঘোষণা করেন , তিনি বা তারা হলেন আইন সম্মত সার্বভৌম ।
আইনগত সার্বভৌমত্ব হচ্ছে যে সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত আদেশ আইনে রূপলাভ করে এবং আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হয়। এক কথায় আইন প্রনয়নের চরম ক্ষমতাই আইনগত সার্বভৌমত্ব। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটেনের রাজা বা রানী সহ পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলেই যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারেন। সুতরাং তাদের আইনগত সার্বভৌমত্ব রয়েছে।
আইনগত সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রিচি বলেন,”আইনগত সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আইনজীবিদের সার্বভৌমত্ব। এটি এমন এক সার্বভৌম ক্ষমতা,যার বাইরে আইনবিদরা তথা আদালত দৃষ্টি দেয় না।
উপযুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও বাস্তবায়নের যে আইনগত ভিত্তি তাই হলো আইনগত সার্বভৌমত্ব।
রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব কি ও বলতে কী বোঝো?
সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা এবং এর যথাযথ অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার জন্য সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন রূপ দেখতে পাই।রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব তার মধ্যে অন্যতম। নিম্নে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের সম্পর্কে
আলোচনা করা হলো :
রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব আইনগত সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন কার্যাবলীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ঘটে। যেমন -ভোট দানের মাধ্যমে, জনগণের মাধ্যমে, নীতিবোধের মাধ্যমে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের স্বরূপ অনুসন্ধান করতে গিয়ে কোন মতৈক্যে আসতে পারে নি।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন –
অধ্যাপক ডাইসী (prof.Diecy)বলেছেন যে, “আইনবিদ যাকে সার্বভৌম বলে স্বীকার করেন এর পশ্চাতে আরেকটি সার্বভৌমের অস্তিত্ব বিদ্যমান। যাকে আইনগত সার্বভৌম মান্য না করে পারেনা আর এটাই হচ্ছে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব।তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক সার্বভৌম হলো যে সংস্থা যার ইচ্ছার প্রতি নাগরিকরা শেষ পর্যন্ত আনুগত্য প্রকাশ করে।
উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেলেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না।
সার্বভৌমত্বের বহুত্ববাদ কি ও বলতে কি বুঝ?
রাষ্ট্র গঠনের প্রধান চারটি উপাদান হলো সার্বভৌমত্ব, জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখন্ড ও সরকার। এ উপাদানগুলোর মধ্যে সার্বভৌমত্ব অন্যতম উপাদান।
সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোন রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। সার্বভৌমত্ব ধারণাটি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি।সার্বভৌমত্ব অর্জন না করলে যেমন রাষ্ট্র গঠিত হয় না,তেমনি সার্বভৌমত্বের বিলুপ্তির সাথে সাথে রাষ্ট্রের ও বিলুপ্তি ঘটে । সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে prof.Miller বলেছেন, “we must recognise the sovereignty state as the prime fact of political life.”
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার চরম,অবাধ এবং অখন্ড অস্তিত্বের প্রচার একত্ববাদ নামে পরিচিত। একত্ববাদের কেন্দ্রীভূত সর্বাত্মক ও অবাধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়ার ফল হল বহুত্ববাদ। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় কেবল একত্ববাদের সমালোচনা হিসেবে নয়,বরং স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে বহুত্ববাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তি ও সংঘজীবনের সর্বত্র রাষ্ট্রের অত্যাধিক প্রধান্য বিস্তার এবং অনাবশ্যক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে, যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, রাজনৈতিক চিন্তাজগতে তা বহুত্ববাদ নামে পরিচিত।
বহুত্ববাদের সার্থক প্রবক্তা হিসেবে গিয়ার্কে,মেইটল্যান্ড, বার্কার,লিন্ডসে,লাস্কি,ম্যাকাইভার প্রমুখ ব্যাক্তির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত বহুত্ববাদের উদ্ভবের পিছনে দুটি কারন আছে।একটি হলো,একত্ববাদী আইনানুগ সার্বভৌমিকতার বিরোধিতা করা এবং অপরটি হলো, রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের স্বাধীন অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা।অধ্যাপক লাস্কি(Laski)বলেছেন,”Because society is federal authority must be federal also.”
উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বহু সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও একত্ববাদই সারা বিশ্বে প্রচলিত। তাদের চিন্তাধারার উপর চিন্তা করেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা মূল্যায়িত হয়। তবে বহুত্ববাদী দের সমালোচনায় অবশ্যই যুক্তি আছে। তারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার উপযোগীতাকে আদৌ উপেক্ষা না করে রাষ্ট্রের চরম,সর্বাত্মক ও অবাধ কর্তৃত্বকে খর্ব করেছে মাত্র ।
জন অস্টিনের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বটির বিশ্লেষন ও উল্লেখ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় সার্বভৌমিকতার ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কমূলক। সার্বভৌমিকতার অর্থ ও প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। ল্যাটিন শব্দ ‘Supreme’অর্থাৎ প্রধান বা চূড়ান্ত। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সার্বভৌমিকতা বলতে এক বিশেষ ক্ষমতা কে বুঝায়।এ ক্ষমতা হলো চরম,চূড়ান্ত ও অবাধ।আর এ ক্ষমতার অধিকারি হলো রাষ্ট্র।
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আইনগত মতবাদের নাম একাত্মবাদ। একত্ববাদিদের মতে, সার্বভৌমত্ব হচ্ছে অবাধ, অসীম ও অবিভাজ্য ক্ষমতা। একত্ববাদ বা আইনগত সার্বভৌমত্বের প্রধান প্রবক্তা হলেন বিখ্যাত ইংরেজ আইনবিদ অস্টিন।১৮৩২ সালে প্রকাশিত ‘আইনশাস্ত্রের উপর বক্তৃতামালা নামক গ্রন্থে তিনি আইনগত সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তঁার সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেন। অস্টিন সার্বভৌমত্ব তত্ব ব্যাখা করতে গিয়ে হবসের নিরষ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌমত্বের সাথে উপযোগবাদী বেন্থামের সার্বভৌমত্ব তত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।ম্যাডিসন প্রমুখ নেতৃবর্গ কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সার্বভৌম বলে ঘোষনা করেন।সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা রাখতে গিয়ে জন অস্টিন মূলত তার নিজের আইন তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জন অস্টিন বলেছেন, “যদি কোন নির্দিষ্ট উর্ধ্বতন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি অপর কোন ঊর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে,সে সমাজের বেশিরভাগ লোকের স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে, তখন সে নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সে সমাজের সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী এবং উক্ত সমাজ একটি রাজনৈতিক ও স্বাধীন সমাজ।”
উপযুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ শুধু গুরুত্বপূর্নই নয়, তা স্বার্বভৌমত্বের মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। তবে বহুত্ববাদীদের সমালোচনা অনুযায়ী জনমত, প্রথা প্রভৃতিকে একেবারে গুরুত্বহীন করা অস্টিনের পুরোপুরি ঠিক হয়েছে কি না এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু একথাও সত্য যে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যত সংঘ বা প্রতিষ্ঠানই থাকুক না কেন, সেগুলোকে পুরোপুরি স্বাধীনতা প্রদান না করে তাদের উপর কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত।গার্নার এর মতে, “সার্বভৌমিকতার আইনগত চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অস্টিনের তত্ব মোটের উপর সুস্পষ্ট যুক্তিপূর্ণ।”