৬ দফা আন্দোলন | ঐতিহাসিক ৬ দফা

রাষ্ট্রবিজ্ঞান

শেখ মুজিবের ৬ -দফা আন্দোলন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের মত এত সুশৃঙ্খল ধারাবাহিক ও সময়োপযোগী কর্মসূচী পৃথিবীতে বিরল। স্বাধীনতার জন্য বাঙালী যে আন্দোলন করেছে তার প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল মাপা। স্বাধীনতা অর্জনের চারদশক পর যখন আমরা ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরাই তখন বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় সে সময়কার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা আর পরিস্থিতি অনুধাবনের বিচক্ষণতা দেখে । বাঙালী প্রথমে তার স্বাধীকারের জন্য লড়াই করেছে। শাসকগোষ্ঠী যখন তা দিতে অস্বীকার করেছে তখন তারা স্বায়ত্তশাসন দাবী করেছে। এটাও যখন শোষকেরা দিতে চায়নি তখন তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, লড়াই করেছে এবং অবশেষে বিজয় অর্জন করেছে। এই নাতিদীর্ঘ সংগ্রামকালে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা ঘোষণা ছিল সংগ্রামের একটি স্তর থেকে অপর স্তরে উন্নীত হওয়ার মাইলফলক স্বরূপ। এটি ছিল এমন একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ দাবীর সমষ্টি যা বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ৬ -দক্ষা দাবী উত্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানী শাসকবর্গকে এমন একটি রাজনৈতিক উভয় সঙ্কটে ফেলে দিয়েছিলেন যা মোকাবেলা করার মত বাস্তব যুক্তি তাদের হাতে ছিলনা। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বুঝেছিল যদি ৬-দফা মেনে নেয়া হয় তাহলে বাঙালী অতি দ্রুত বিকশিত হয়ে এমন এক শক্তিশালী সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হবে যাদের আর কোন দিনও পদানত করা সম্ভব হবে না।

আর ৬-দফা মেনে না নিলে সংঘাত অনিবার্য যে সংঘাতের ফলাফল তাদের জন্য সুফল কিংবা কুফল উভয়ের যে কোন একটি বয়ে আনতে পারে। যেহেতু পাকিস্তানী শাসকেরা বাঙালীর প্রতিভাকে ভয় পেয়েছিল সেহেতু তারা প্রথম পথটি গ্রহণ করেনি। তারা সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছিল যে সংঘাতে বাঙালী জয়ী হতে পারবেনা। কিন্তু তারা শুধু অতীতকে বিশ্লেষণ করেছিল। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বাঙালী যে ততক্ষণে একটি ভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে তা তারা অনুধাবন করতে পারেনি। তাই ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী অস্ত্রের ভাষায় মোকাবেলা করতে গিয়ে ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক পরাজয়ের স্বাদ তাদের গ্রহণ করতে হয়েছে।

৬-দফার পটভূমি

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রাক উপনিবেশিক আমলে বাঙলা তথা ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের কোন ধারণা সাধারণ
জনগণের মধ্যে বিকশিত হয়নি। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হলে পূর্ববাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে তাদের সে আশা ভঙ্গ হলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে তারা পূর্ববাংলার মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে পুনরায় বাংলার মানুষের স্বাধীন সত্তা হিসেবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু আলাদা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ব্যর্থ হলেও পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বাঙালী নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক শাসকদের চরম কেন্দ্রীকরণ নীতি ও বাঙালীকে অবহেলার নীতি পূর্ববাংলার মানুষকে পুনরায় আশাহত করে। তবে ১৯০৫ সালের আশাহত বাঙালী আর ১৯৪৭ সালের আশাহত বাঙালি এক নয়। ১৯০৫ সালে আশাহত বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক কোন শক্তিশালী মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়াশ্রেণী ছিলনা। কিন্তু বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে

পূর্ববাংলার মানুষের সফল অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা ১৯৪৭ সালে তাদের একটি ভিন্ন জাতিতে পরিণত করেছিল। এ সময়ে বাঙালির মনন ও মেধার যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি থেকে বাঙালি অনেক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এখন তার রয়েছে এক বিশাল ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়। রয়েছে পাকিস্তান আন্দোলনে বিজয় লাভ করা এক বৃষ্টি তরুন নেতৃত্ব। সেই সাথে রয়েছে ছোট অথচ বিকাশমান মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণী যারা শাসক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সীমিত পরিসরে হলেও অর্থায়ন করতে সক্ষম। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবর্গের শোষণের প্রক্রিয়া তাদেরকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সাহসী করেছে। শুধু প্রয়োজন ছিল একটি সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব। পূর্ববাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সেই সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের গুণাবলী খুঁজে পায়। ফলে ৬-দফা হয়ে ওঠে তাদের মুক্তিসনদ আর মুক্তিব ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা দাবী উত্থাপনের যৌক্তিকতা বুঝতে হলে ১৯৪৭ – ১৯৬৬ সময় কালে পাকিস্তানী শাসক বর্গের পূর্ববাংলার প্রতি শোষণ মূলক আচরণ এবং এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আলোকপাত করা প্রযোজন।

৬-দফার সামাজিক পটভূমি

মুসলিম ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান দিয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালিদের কখনও তাদের সম মর্যাদাসম্পন্ন বলে ভাবতে পারেনি। তাদের ধারণা বাঙালিরা নিম্নশ্রেণীর হিন্দু হতে ধর্মান্তরিত মুসলমান হওয়ায় এরা প্রকৃত মুসলমান নয়। এরা নিচু জাত। এরূপ জাত্যাভিমান তাদের সকল প্রকার আচার – আচরণ ও নীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। আর তাই তারা বাঙালির সকল কিছুতেই অপবিত্রতার বা হিন্দুত্রে ছাপ খুঁজে পায়। বাংলা ভাষা ও বাংলা শব্দকে তারা হিন্দুয়ানী ভাষা বলে গণ্য করে এবং এজন্য একে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা উর্দুকে রই ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নেয়। ভাষার উপর আঘাতকে যখন পূর্ববাংলার মানুষ তাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকী বিবেচনা করে প্রবল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিলেও একে ইসলামীকরণ করার জন্য কখনও রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রয়াস নেয়; কখনও বা বাংলা সাহিত্য থেকে বেছে বেছে তাদের ভাষায় হিন্দুশকা গুলো বাদ দিয়ে উর্দু ফার্সী শব্দ বসিয়ে এক জগাখিচুরী সাহিত্য তৈরির প্রয়াস চালায়। আবার কখনও রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে বাঙালি জাতিকে তাদের ভাষায় ‘হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য। বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবর্গের এরূপ বিমাতাসূলভ আচরণের শুরুটা করেছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী


জিন্নাহ। তিনি একটি শক্তিশালী পাকিস্তান গড়ে তোলার স্বার্থে পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিদের অসমসাহসী ভূমিকার ইতিবাচক মূল্যায়নের পরিবর্তে বরং তা অস্বীকার করেছিলেন। তার মতে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার এবং তার টাইপরাইটারের বদৌলতে। অথচ আমরা দেখেছি ১৯৪৬ সালে যখন ভারতের ১১ টি প্রদেশে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল তখন একমাত্র বাংলা ব্যতীত অপর কোন প্রদেশের মুসলিমলীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। বাংলার মুসলমানের ম্যান্ডেটের জোরে সমগ্রভারতের মুসলিম লীগের মেরুদন্ড সোজা ছিল। অথচ জিন্নাহ বাঙালির এ কৃতিত্বকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি নিজ হাতে বিনষ্ট করেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ জিন্নাহ পূর্ববাংলায় প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন। সমগ্র পূর্ববাংলার মানুষ যখন তার নিকট থেকে আশার বাণী শোনার জন্য উদগ্রীব তখন তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনাকীর্ণ জনসভা সদম্ভে ঘোষণা করেন’ Urdu, and urdu shall be the state language of Pakistan. এমন কি পরবর্তী ২৪ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন কে পাকিস্তানের শত্রুদের কারসাজি বলে মন্তব্য করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনকারীদের ‘পঞ্চম বাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করেন। জিন্নাহর এরূপ স্বৈরাচারী বক্তব্য একদিকে পাকিস্তানের শোষক শ্রেণীকে বাঙালিদের উপর শোষণের স্টীমরোলার চালাতে উৎসাহিত করে অন্যদিকে বাঙালিদের দ্বি – জাতিতত্ত্বের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটায়। জিন্নাহর এরূপ নীতি শুরুতেই পাকিস্তানের
উভয় অংশের জনগোষ্ঠীর মাঝে অবিশ্বাসের দেয়াল গেঁথে দেয়। এর ফলে ১৯৫২ সালে প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালী রক্তদানের বিনিময়ে তার ভাষার অধিকার আদায় করে নেয়।

৬-দফার রাজনৈতিক পটভূমি

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনে বলা হয়েছিল নতুন সংবিধানে প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় ডোমিনিয়ন এবং পাকিস্তান ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতা লাভের পরপরই একটি সুসম সংবিধান প্রণয়নের কাজে হাত দিলেও পাকিস্তানের শাসকবর্গ ১৯৩৫ সালের আইনের ত্রুটির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে একেবারে গোড়ার দিক থেকেই পূর্ববাংলাকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করে ফেলে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পূর্ববাংলায় বাস করলেও রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করে প্রায় সকল রাজনৈতিক পদগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়োগ দেয়া হয় । কেন্দ্রকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে প্রদেশ গুলিকে। স্বায়ত্তশাসন প্রদানের পরিবর্তে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল করে ফেলা হয়। ১৯৪৮ সালে Pakistan Provincial Constitution (3rd Amendment) Order জারীর মাধ্যমে প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করা হয়। এ সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয় গভর্নর জেনারেল যদি মনে করেন পাকিস্তান কিংবা তর কোন অংশের শান্তি ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে কিংবা এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যাতে প্রাদেশীক সরকার দায়িত্ব পালনে অপরাগ সেক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল উক্ত প্রদেশের সকল ক্ষমতা নিজ হাতে গ্রহণ করতে পারবে। এভাবে প্রাদেশীক সরকারের স্থায়ীত্ব গভর্নর জেনারেলের ‘ইচ্ছা’ বা ‘মনে হওয়ার’ উপর সমর্পন করা হয়। তাছাড়া
আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে প্রদেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। কেননা পাবলিক সার্ভিসের অফিসারবৃন্দ প্রদেশের সচিবালয় বা সরকারী অফিসগুলোতে কর্মরত থাকলেও এদের নিয়োগ-বদলী-পদোন্নতি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ফলে তারা প্রাদেশীক সরকারের নির্দেশ মানার পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুম তামিল করতেন।



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

four × 5 =