ব্রেইন টিউমারের লক্ষণসমূহ
ব্রেইন টিউমার হল মস্তিষ্কে সৃষ্ট একটি অস্বাভাবিক কোষের গঠন, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে। এটি ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সার) বা বেনাইন (অ-ক্যান্সার) হতে পারে। ব্রেইন টিউমারের লক্ষণগুলি প্রাথমিকভাবে টিউমারের অবস্থান, আকার, ও বৃদ্ধির হারের উপর নির্ভর করে। নিচে ব্রেইন টিউমারের বিভিন্ন লক্ষণ এবং তাদের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হল।
১. মাথাব্যথা
মাথাব্যথা ব্রেইন টিউমারের একটি সাধারণ লক্ষণ। এই মাথাব্যথার ধরন এবং তীব্রতা অন্যরকম হতে পারে:
- প্রকৃতি: সাধারণত মাথাব্যথা স্থায়ী হয় এবং ধীরে ধীরে তীব্র হয়।
- সময়: সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মাথাব্যথা বেশি অনুভূত হতে পারে।
- ব্যথার স্থান: সারা মাথায় ব্যথা হতে পারে, বা নির্দিষ্ট একটি স্থানে।
২. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও কগনিটিভ ফাংশন
টিউমার মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে চাপ সৃষ্টি করলে বিভিন্ন কগনিটিভ ফাংশন বিঘ্নিত হতে পারে:
- মেমরি সমস্যা: সাম্প্রতিক ঘটনা মনে রাখতে সমস্যা হতে পারে।
- মনের অস্থিরতা: একাধিক কাজ করতে সমস্যা এবং মনোযোগের অভাব দেখা দিতে পারে।
- বুদ্ধিমত্তার অবনতি: চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
৩. দৃষ্টি সমস্যা
ব্রেইন টিউমার চক্ষু স্নায়ুকে চাপ দিলে দৃষ্টিতে সমস্যা হতে পারে:
- দৃষ্টি ঝাপসা: হঠাৎ করে দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে।
- দ্বৈত দৃষ্টি: এক বস্তু দুইটি দেখা।
- দৃষ্টির ক্ষেত্র সংকুচিত: পার্শ্বীয় দৃষ্টি কমে যেতে পারে।
৪. বমি ও বমিভাব
টিউমার মস্তিষ্কের চাপ বৃদ্ধি করলে বমি ও বমিভাব হতে পারে। সাধারণত সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়।
৫. পেশি ও চলাচলের সমস্যা
মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে চাপ পড়লে পেশি ও চলাচলের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে:
- পেশির দুর্বলতা: এক বা একাধিক অঙ্গে দুর্বলতা অনুভব করা।
- সামঞ্জস্য সমস্যা: হাঁটতে বা চলতে সমস্যা হতে পারে।
- দুর্বল গ্রিপ: হাতের শক্তি কমে যাওয়া।
৬. খিঁচুনি
টিউমার খিঁচুনির কারণ হতে পারে, বিশেষত যদি এটি কর্টেক্সে থাকে:
- প্রাথমিক খিঁচুনি: হাত, পা বা মুখের একটি নির্দিষ্ট অংশে খিঁচুনি শুরু হতে পারে।
- সেকেন্ডারি খিঁচুনি: খিঁচুনি সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে।
৭. ব্যক্তিত্ব ও আচরণের পরিবর্তন
মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যক্তিত্ব এবং আচরণের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে:
- আচরণের অস্থিরতা: অকারণ রাগ, বিষণ্নতা বা উদ্বেগ।
- সামাজিক আচরণ পরিবর্তন: সামাজিক দক্ষতা হ্রাস।
৮. ভাষাগত সমস্যা
ব্রেইন টিউমার কথা বলার এবং বুঝার ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে:
- বাচন সমস্যা: কথা বলতে অসুবিধা।
- শব্দ খুঁজে পাওয়ার সমস্যা: ঠিক শব্দ খুঁজে পেতে সমস্যা।
৯. শ্রবণ সমস্যা
মস্তিষ্কের শ্রবণ স্নায়ুতে চাপ পড়লে শ্রবণ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে:
- শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস: এক বা দুই কানেই শুনতে সমস্যা।
- টিনিটাস: কানে ঘণ্টাধ্বনি বা বাজনার শব্দ।
১০. অনুভূতির সমস্যা
টিউমার স্নায়ুতে চাপ দিলে বিভিন্ন ধরনের সংবেদনশীলতার পরিবর্তন ঘটতে পারে:
- নামমাত্র অনুভূতি: একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে সংবেদনশীলতা হ্রাস।
- পিন ও সূচ অনুভূতি: হাত বা পায়ে সুচ বিঁধার মত অনুভূতি।
১১. স্বল্পমেয়াদী স্মৃতির সমস্যা
প্রথমদিকে সাম্প্রতিক ঘটনা মনে রাখতে অসুবিধা হয়। এরপর সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য স্মৃতিরও সমস্যা হতে পারে।
১২. ভারসাম্য ও সমন্বয় সমস্যা
টিউমার মস্তিষ্কের সেরিবেলাম অংশে চাপ দিলে ভারসাম্য ও সমন্বয়ের সমস্যা দেখা দিতে পারে:
- ভারসাম্য হারানো: হাঁটা বা দাঁড়াতে অসুবিধা।
- চলাফেরা অস্থির: চলাফেরার সময় হাত-পা সমন্বয় করতে সমস্যা।
ব্রেইন টিউমারের লক্ষণগুলি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে এবং উপরোক্ত লক্ষণগুলি যে কোনও একটি বা একাধিক উপস্থিত থাকলে তা ব্রেইন টিউমারের ইঙ্গিত হতে পারে। যদি কেউ উপরোক্ত লক্ষণগুলি অনুভব করেন, তাহলে দ্রুত ডাক্তার বা স্নায়ু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তার সাধারণত MRI বা CT স্ক্যানের মাধ্যমে টিউমারের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করেন।
ব্রেইন টিউমার কেন হয়
ব্রেইন টিউমার কেন হয় তা এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি, তবে এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে। নিচে ব্রেইন টিউমার সৃষ্টির কিছু সাধারণ কারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো।
জিনগত কারণ
ব্রেইন টিউমার সৃষ্টির অন্যতম কারণ হতে পারে জিনগত পরিবর্তন। কিছু নির্দিষ্ট জিনগত মিউটেশন বা পরিবর্তন মস্তিষ্কের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। এই জিনগত পরিবর্তনগুলি কখনো বংশগত হয় এবং কখনো জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটতে পারে।
বংশগত কারণ
কিছু বংশগত রোগ ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। যেমন:
- নিউরোফাইব্রোমাটোসিস টাইপ 1 (NF1) এবং টাইপ 2 (NF2): এই রোগে মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডে টিউমারের ঝুঁকি থাকে।
- টিউবারাস স্ক্লেরোসিস: এই রোগে মস্তিষ্কে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে বেনাইন টিউমারের ঝুঁকি থাকে।
- লি-ফ্রাউমেনি সিনড্রোম: এই বিরল বংশগত রোগে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারসহ ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি থাকে।
রেডিয়েশন
ব্রেইন টিউমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল রেডিয়েশন এক্সপোজার। বিশেষত, থেরাপিউটিক রেডিয়েশন (যেমন ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিয়েশন থেরাপি) ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ইমিউন সিস্টেম দুর্বলতা
যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল বা যারা ইমিউনোস্প্রেসিভ ওষুধ গ্রহণ করেন (যেমন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর), তাদের ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি বেশি হতে পারে।
বয়স
বয়স ব্রেইন টিউমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি বেশি দেখা যায়, তবে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ব্রেইন টিউমার শিশুদের মধ্যেও হতে পারে।
পরিবেশগত কারণ
কিছু গবেষণা পরামর্শ দেয় যে কিছু পরিবেশগত কারণ যেমন বিষাক্ত রাসায়নিক বা ভাইরাসের সংস্পর্শ ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তবে, এই কারণগুলি এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়।
জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাস
যদিও সরাসরি কোনও প্রমাণ নেই, তবে জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস কিছু পরোক্ষ প্রভাব রাখতে পারে। যেমন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং তামাক ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা সাধারণত স্বাস্থ্যের অন্যান্য দিকের মতো ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।
অন্য ক্যান্সারের মেটাস্টাসিস
কিছু ক্ষেত্রে, শরীরের অন্য কোনও অংশের ক্যান্সার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মেটাস্ট্যাটিক ব্রেইন টিউমার সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, ফুসফুস, স্তন, কোলন বা কিডনির ক্যান্সার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভ্রূণীয় কোষের অস্বাভাবিকতা
কিছু ব্রেইন টিউমার (যেমন গ্লিওমা) ভ্রূণীয় কোষের অস্বাভাবিকতা থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এই কোষগুলি জন্মের সময় থেকেই মস্তিষ্কে উপস্থিত থাকতে পারে এবং পরবর্তীতে টিউমারে পরিণত হতে পারে।
ব্রেইন টিউমারের কারণ এখনও সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়নি, তবে উপরে উল্লেখিত কারণগুলি এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে। প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে কারণগুলি ভিন্ন হতে পারে, এবং একটি নির্দিষ্ট কারণ নির্ধারণ করা সবসময় সম্ভব নয়। চিকিৎসা এবং গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত এই কারণগুলি আরও ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন, যা ভবিষ্যতে ব্রেইন টিউমারের প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা উন্নত করতে সহায়ক হবে।