ভাষা আন্দোলন কি | ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

ইতিহাস

১৮৩৫ সালে সরকারী ভাষা হিসেবে এদেশে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অঅবুল কাশেমের নেতৃত্বে ‘তমদ্দুন মজলিশ’ (Tamuddun Majlish) নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে চালু করার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে ‘তমদ্দুন মজলিশ’। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ প্রকাশ করে। এ পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন- অধ্যাপক আবুল কাসেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতে অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে সরকারী স্বীকৃতির দাবি জানান । কিন্তু গণপরিষদ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে পূর্ব বাংলার ছাত্র শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কামরুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ (All Parties State Language Movement Association) গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে সরকারের ষড়যন্ত্র রোধ করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় । ঐ দিন ঢাকায় বহুছাত্র আহত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে গ্রেফতার হন ৷ এজন্য ১৯৪৮-৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময়কালে প্রতি বছর ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ (Language day) হিসাবে পালন করা হতো ।

ভাষা আন্দোলনের ছবি আঁকা

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ । ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা ‘না না” বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায় । ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলা সরকার বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’ গঠন করে। মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন এ কমিটির সভাপতি। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে।’ ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২ আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা  ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক দলের সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্ৰীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার আহবায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) রোজ বৃহস্পতিবার ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সারাদেশে হরতাল কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে হয়ে নুরুল আমিন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরে সমবেত হয়। পুলিশ উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বাধে।

পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি বর্ষণ করলে আবদুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বার প্রমুখ শহীদ হন। নয় বছরের শিশু ওহিউল্লাহও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিশাল শোভা যাত্রা বাহির হয় । এ শোভাযাত্রার উপরও পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ফলে শফিউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন । ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে এই আন্দোলন তার লক্ষ্য অর্জন করে । জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬) এক পর্যায়ে এর সদস্য ফরিদপুরের আদেলউদ্দিন আহমেদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বাংলা ভাষাকে জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারের জন্য আইন পাস হয়। সিয়েরালিয়ন বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে। বর্তমানে ভাষাভাষী জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলা ভাষার অবস্থান বিশ্বে ৭ম।

১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ UNESCO ৩১তম বৈঠকে ভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ (International Mother Language day) হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে সর্বপ্রথম দিবসটি পালিত হয়। উল্লেখ্য, UNESCO ২০০৩ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করে।



About author

saikat mondal

Welcome to www.banglashala.com. Banglashala is a unique address for Bengali subjects. banglashala is an online learning platform for Bengalis. So keep learning with us




Leave a Reply

3 × 1 =